নিজস্ব সংবাদদাতা: প্রায় আড়াই দিনের মাথায় ফরম্যাট পরিবর্তন করে কোভিড বুলেটিন প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর সেই ফরমেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মোট আক্রান্তের পরিমান। অথচ দেশের সমস্ত রাজ্য আর কেন্দ্র তাদের ফরম্যাটে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করছে মোট আক্রান্তের পরিমানকে। কারন করোনা সহ যে কোনও মারনঘাতি মহামারীর মোকাবিলায় এই তথ্যটা খুবই জরুরি।
শনিবার রাত ৯ টা নাগাদ প্রকাশিত এই বুলেটিনে আরও একটি উদ্বেগ ধরা পড়েছে এবং তা’হল গত দু’দিনে রাজ্যে করোনা সন্ক্রমনে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। আর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১২৭ জন। সব মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাফে হয়ে গেছে ৪৮।
উল্লেখ্য মোট আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রের মধ্যে ফারাকের বিরোধ ছিলই। এমন কি রাজ্যের অভিযোগ ছিল আক্রান্তের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে কেন্দ্র। কিন্তু এরপর গত বৃহস্পতিবার যা হল তা এক কথায় নজির বিহীন। ওই দিন রাজ্য সরকারের মধ্য থেকেই দুটি ভিন্ন মত প্রকাশিত হয় গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন বিকালে নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্যের মূখ্য সচিব রাজীব সিনহা জানান রাজ্যের মোট আক্রান্ত ৭৪৪। রাজীব সিনহার তথ্য অনুযায়ী ওই দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকেল অবধি রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ৫৭২ জন, সুস্থ ১৩৯ জন এবং মৃত ৩৩ জন। সব মিলিয়ে ৭৪৪ জনের হিসেব জানিয়েছিল রাজ্য। অথচ অথচ ওই দিনেই দুপুরে কেন্দ্র স্বাস্থ্য সচিব প্রীতি সুদনকে পাঠানো রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব বিবেক কুমারের পাঠানো চিঠিতে দেখা গেল কোভিড আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৯৩১। অর্থাৎ একই দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৭ জনের ফারাক।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, এরপরই পুরো ৫০ ঘন্টা আর বুলেটিন প্রকাশ করেনি রাজ্যসরকার। তারপর শনিবার রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর যে বুলেটিন এদিন প্রকাশ করল করল তাতে দেখা গেল আগের ফরম্যাট ফের বদল করা হয়েছে। আর সেই ফরম্যাট থেকে উধাও হয়ে গেছে আক্রান্তের সংখ্যা। উল্লেখ্য এই নিয়ে গত দেড় মাসের মধ্যে দু’বার বুলেটিনের ফরম্যাট বদল করা হল। প্রথম ফরম্যাট অনুযায়ী জানানো হত, রাজ্যে মোট কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন কত জন। পরে সেই ফরম্যাট বদল করে মুখ্য সচিব রাজীব সিনহা তাঁর প্রেস কনফারেন্সে জানাচ্ছিলেন, সেদিন রাজ্যে কত জনের শরীরে কোভিড অ্যাকটিভ রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিনেও তা জানানো হচ্ছিল। কিন্তু শনিবার রাত ৯ নাগাদ যে বুলেটিন প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য দফতর তাতে রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্তের উল্লেখ তো নেই, সেই সঙ্গে এও বলা হয়নি যে এই মুহূর্তে কতজন কোভিড অ্যাকটিভ রোগী।
শনিবার নতুন ফরম্যাটে রাজ্য সরকার দু’দিনের পৃথক পৃথক বুলেটিন প্রকাশ করে। ১ মে-র জন্য যে বুলেটিন ঘোষণা করেছে তাতে বলা হয়েছে, সেদিন ৫৭টি ‘নতুন করোনা পজিটিভ কেস’ পাওয়া গিয়েছে। ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে-র মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ জন। আর কোভিড আক্রান্ত হয়ে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দ্বিতীয় অর্থাৎ ২ মে-র বুলেটিন অনুযায়ী শনিবার করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে রাজ্যের আরও ৭০ জন মানুষের শরীরে। শনিবার কোভিডে মারা গিয়েছেন ৭ জন রোগী। তবে ইতিবাচক যে এদিন আরও ৪৫ জন কোভিড আক্রান্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
বুলেটিনে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। তা হল, রাজ্যে কোভিড টেস্টের সংখ্যা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। গত সপ্তাহে দিনে গড়ে কম বেশি ৯০০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিন অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল রাজ্যে ২০৪১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আর শুক্রবার ১ মে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৪১০ জনের। এবং স্বাস্থ্য দফতরের হিসাবে অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত রাজ্যে ২০,৯৭৬ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বুলেটিনেই বলা হয়েছে, রাজ্যে এখন আইসিএমআর-এর অনুমোদিত ল্যাব রয়েছে ১৬ টি। এতোগুলি ল্যাবে পরীক্ষা হওয়ার কারণেই টেস্টের সংখ্যা বেড়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য ভবনের এই বুলেটিন অস্বচ্ছ ,অভিযোগ করে লোকসভার কংগ্রেস সংসদীয় নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, “কোনও সমালোচনাই এই সরকারের গায়ে লাগে না। এঁদের প্রশাসনিক ব্যাকরণ বলে কিছু নেই। কী করে সত্য গোপন করবে সেটাই ধ্যান ও জ্ঞান হয়ে গিয়েছে। এই বুলেটিনেও বলা হল না যে গোটা বাংলায় এখনও পর্যন্ত কত জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সেটা জানা গেলে মানুষের বিভ্রান্তি কমত। মানুষ হয়তো আরও সচেতন হতেন”।
বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “একবার যদি তথ্য গোপন করা শুরু হলে মুখ্যমন্ত্রী যতই চেষ্টা করুন অঙ্ক মেলাতে পারবেন না। তাতে ৫০ ঘণ্টা পর বুলেটিন দিক আর পাঁচদিন পর দিক। মোট কত আক্রান্ত বলছিলেন না মাননীয়া। কিন্তু ঢাকবেন কী দিয়ে! স্বাস্থ্য সচিবের চিঠি তে বেরিয়ে পড়েছে। আজও বুলেটিনে মোট আক্রান্তের উল্লেখ নেই। আক্রান্ত আর মৃত্যুর যা অনুপাত দাঁড়াচ্ছে তাতে বাংলা রেকর্ড গড়ার মুখে। এখনও সময় আছে সব তথ্য স্বচ্ছ ভাবে প্রকাশ করুক সরকার।”
সমালোচনা যাই হোকনা কেন দুদিনে ১৫ জনের মৃত্যু হওয়াটা নিশ্চিত ভাবেই উদ্বেগের কারন বৃহস্পতিবার অবধি রাজ্যে মোট মৃত্যুর অঙ্ক ছিল ৩৩ যা কিনা এপ্রিলের গোড়া থেকে শুরু হয়েছিল আর মে মাসের শুরুর দুদিনেই প্রায় ৫০% বেড়ে সংখ্যাটা ৪৮ হয়ে গেল। কেন্দ্রের একটি পরিসংখ্যানে ঠিক এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা উদ্বেগ জনক, প্রতি সাত দিনে দ্বিগুণ হবার পথে রাজ্য। এখন প্রশ্ন সত্যিই সেই পর্বে প্রবেশ করে গেল কিনা বাংলা।