অশ্লেষা চৌধুরী: সে ছোট কিন্তু ভাইদের চেয়ে যে বড়! লকডাউনে কাজ নেই বাবার, স্কুলে নেই মিড ডে মিল, চার ভাইয়ের ১বেলার ভাত তাই বন্ধ ছিল। তাই সংসারের চাপ কমাতে সেও নেমে পড়েছিল মালদার সেই কারখানার কাজে যেখানে বিস্ফোরণে ৬ জনের সাথে নিহত সেই ক্লাশ সেভেনের ছেলেটাও! যার নাম আজিজুল রহমান। বাংলার এক হতভাগ্য শিশু শ্রমিক!
কালিয়াচকের সুজাপুর নাজিরপুরে বাড়ী আজিজুল রহমানের। বাবা-মা ও ছোট তিন ভাইয়ের সাথে বাস আজিজুলের। নাজিরপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সে। অভাব-অনটনে ভরা সংসার। পেটের তাগিদে ও পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে ছোট্ট কাঁধে তুলে নেয় কাজের ভার। দৈনিক স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে প্লাস্টিক কারখানায় কাজে যোগ দেয় আজিজুল।
জানা গিয়েছে, আজিজুলের বাবা মোস্তাফা শেখ নিজের জায়গায় কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ে তিনি শ্রমিকের কাজ করতেন। মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল সবই। বাধ সাধল করোনা। করোনা রুখতে জারি হল দেশ জুড়ে লকডাউন। তার জেরেই কাজ হারালেন মোস্তাফা বাবু। এমনকি নিজের পরিবারের কাছেও ফিরতে পারেননি বহুদিন। মুম্বাইতেই আটকে থাকতে হয় তাঁকে। আর এদিকে চরম সমস্যায় পড়েছিল পরিবার। ঘরে বাড়তে থাকে আরও অভাব। টান পড়তে থাকে আজিজুলদের পেটে। এদিকে করোনা আবহে বন্ধ স্কুল, আর সেই সাথেই বন্ধ স্কুলের মধ্যাহ্ন কালীন আহার টুকুও।
এমন সময় উপায় না দেখে নিজের ছোট্ট কাঁধে সংসারের দায়ভার তুলে নেয় আজিজুল। গ্রামের পাশেই সুজাপুরে প্লাস্টিক কারখানা । সেখানেই প্লাস্টিক বাছাই ও কাটার কাজ করে এলাকার বহু যুবক। সেখানে কিছু অল্প বয়সের ছেলেরাও কাজ করে। তাদের মধ্যে যোগ দেয় আজিজুল রহমান। কারখানায় ১৮০ টাকা করে দৈনিক মজুরির বিনিময়ে কাজে যোগ দেয় সে। সেই টাকা পরিবারের হাতে তুলে দিত আজিজুল। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ, তাই সেই সময়টাকেই কাজে লাগায় সে। নিজেকে পরিণত করে প্লাস্টিক কারখানার শিশু শ্রমিকে।
প্রতিদিনের মত গতকাল বৃহস্পতিবারও সকালে বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করে কারখানায় কাজে গিয়েছিল আজিজুল। কিন্তু রোজকার মত আর ফিরে আসা হল না তার। বেলা ১১ টা নাগাদ কারখানায় এক ভয়ানক বিস্ফোরণ হয় এবং সেই বিস্ফোরণেই ছিন্নবিন্ন হয়ে যার তার দেহ। সংসারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া ছোট ছোট সেই হাত পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় চিরতরে। শোকে ভেঙ্গে পড়ে আজিজুলের পরিবারে সকলে। সেইসাথে গোটা এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।
প্রসঙ্গত, গতকাল সকালে সুজাপুরের প্লাস্টিক কারখানা প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় চার জনের, এরপর হাসপাতালে যাওয়ার পথে আরও একজন মারা যান। আজ সকালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ জনে। ঘটনায় আহতও হন অনেকে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান ঘোষণা করা হয় মৃত ও আহতদের পরিবারের জন্য। খবর পেয়ে গতকালই ছুটে আসেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কী কারণে এই বিস্ফোরণ তা স্পষ্ট নয় এখনও। ফরেন্সিক দল দুর্ঘটনার স্থান খতিয়ে দেখতে আসেন। আশ্বাস দেন সঠিক তদন্ত হবে।
যদিও সবকিছুর মধ্যে একটা প্রশ্ন- স্কুলে পড়ার বয়সে, আনন্দ করার বয়সে ছোট্ট আজিজুলের পেটের তাগিদে কারখানায় কাজ করা, আর তারপর তার এই মর্মান্তিক মৃত্যু, এটাই কী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, যে আমাদের রাজ্যে শিশু শ্রমিকের মত জ্বলন্ত সমস্যা আজও রয়ে গিয়েছে!