নরেশ জানা : নায়াগ্রাম: মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সাধের জঙ্গলকন্যা সেতুর নিচে সুবর্নরেখার চরে ভ্যান রিকশা থেকে নামানো হল ২৮ বছরের মঙ্গল মান্ডিকে। উন্নয়নের জঙ্গলমহলের যুবক মঙ্গল কাজ জোটেনি পোড়া বাংলাদেশে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে নাকি জঙ্গলমহলের পিঁপড়ে খেত, এখন সিলিকোসিস খায়, পাথরের গুঁড়ো। মঙ্গল মান্ডি আদিবাসী, সাঁওতাল জনগোষ্ঠির যুবক। কাজের জন্য ভিন রাজ্যে গেছিল, যেমনটা গেছিল জঙ্গলমহলেরই গোবিন্দ জানা, তাপস দন্ডপাট,
মিলন পাত্র, সুব্রত বেরা, রামকৃষ্ণ মন্ডলেরা। এঁদের কেউ মারা গেছে, কেউ কাল পরশু মারা যাবে, যেমনটা মারা বুধবার গেলেন মঙ্গল মান্ডি।
২৮ বছরের মঙ্গল সংসারের মুখে,বৃদ্ধ বাবা-মা আর ভাইয়ের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে ভিন রাজ্য ঝাড়খণ্ড গেছিলেন কারন এ রাজ্য, মমতাময়ী রাজ্যে তাঁদের কাজ জোটেনা। তাই জঙ্গল মহলের একঝাঁক তাজা প্রান একটা একটা করে এভাবেই নিভে যাচ্ছে মারাত্মক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। দিন মজুর, মৎস্যজীবী পরিবারের ছেলেরা কাজের সন্ধানে পাশের পড়শি রাজ্যের জামসেদ পুরে ক্রাসারে কাজ নেয় দালাল মারফৎ। ফিরে আসে বুকে পাথর গুঁড়ো ভরে নিয়ে। মঙ্গলও ফিরেছিল। তারপর বুধবার প্রায় ছয় মাস বিছানা শয্যা থাকা মঙ্গল মারা যায় একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ। মঙ্গল যে মারা গেছে তা বলেছে তার বাবা ৬২ বছরের কালীচরণ মান্ডি। না, মৃত্যু নিশ্চিত করতে কোনও ডাক্তার আসেনি। করোনা আবহে ডাক্তার আসেনা, আসেনা পড়শিরাও।
নয়াগ্রাম ব্লকের সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী বাহিনী গ্রামে বসবাস। জেলে মৎস্যজীবী পাড়ায় একমাত্র আদিবাসী পরিবার। পাশের গ্রাম ডাহিতেও ইতিমধ্যে তিন জন মারা গেছে ওই সিলিকোসিস আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যু মিছিল চলছেই। মঙ্গলের বাবা স্বজাতি আত্মীয় দের খবর দিলে করোনার ভয়ে কেউ আসেনি। মৃত পুত্র কে নিয়ে বৃদ্ধ বাবা ও মা প্রতি বেশি দের ও সাহায্য না পেয়ে নয়াগ্রাম থানার সামনে বসে কান্না কাটি করতে দেখে এগিয়ে আসেন দক্ষিণ বঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের নয়াগ্রাম ব্লক সভাপতি গোপাল দন্ডপআট। একটা ভ্যান রিকশায় মঙ্গলকে চাপিয়ে সুবর্ণরেখা নদী চরে যখন পৌঁছায় সূর্য অস্ত গেছে। মঙ্গলদের দাহ করার নিয়ম কিন্তু কাঠ কাটার লোক নেই তাই মরার পরও অবহেলা, মুখে আগুন জোটেনি। ভাই কোদাল দিয়ে নদীর চরে গর্ত করে বাবা মা শুইয়ে দেয় গর্তে। যন্ত্রনার চির অবসান।
মাস খানেক আগেই মৃত্যু হয়েছে ৪৭বছরের গোবিন্দ জানার। আড়াই মাস কটকে থাকার পর কলকাতার পিজি, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি ও নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়ে ভাঙাগড় স্বাস্থ্য কেন্দ্র ঘুরে মেদিনীপুরে মৃত্যু। ১৭বছরের ছেলে কে নিয়ে স্ত্রী মলিনা আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন!”
যে গোপাল দন্ডপাট মঙ্গলের শবযাত্রার একমাত্র বন্ধু তার ছেলেরও একই অবস্থা। একমাত্র ছেলে ২৫ বছরের তাপস, নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে। ১বছর কাজ করেছিলেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জমশেদপুরের বিস্টুপুরের ক্র্যাশার বা পাথর গুঁড়ো করার কারখানায়। গুগুল সার্চ করে দেখতে পান যে এই ক্র্যাশার থেকেই ছড়ায় মারন রোগ সিলিকোসিস। কিন্তু পালিয়ে এসে রক্ষা নেই। প্রথমে কাশি তারপর শ্বা:সকষ্ট আর জ্বর। প্রথমে কটক তারপর পিজি এবং তারপর দিল্লি এইমস। ফুসফুসে বাইপাশ। সেখান দিয়েই সরবরাহ করা হত অক্সিজেন। এরপর বাড়ি এসে ফের অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। ডাহি গ্রামের বাসিন্দা তাপসকে বাঁচাতে ঘটি বাটি সব বিক্রি হয়ে গেছে।
একই ভাবে ১বছরের ছেলেকে নিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছেন ২০বছরের নমিতা পাত্র। নয়াগ্রাম থানার রাইপড়িয়া গ্রামের নমিতার স্বামী মাত্র ২৪বছরের মিলন গত দেড়বছর আক্রান্ত। ঘোরা হয়ে গেছে পিজিও। অকাল বৈধব্যর আশংকায় চুঁইয়ে গেছে যৌবন। তিনবছর আগে বিয়ে হওয়া তরুনী এখন যে কোনও দিনই….।
একবছরের মধ্যে কাজে গিয়ে ছয় মাসের মধ্যে ইতিমধ্যে মারা গেছে সুব্রত বেরা পিতা দেবেন্দ্র বয়স ১৯ বছর। বাড়ি বাহিনী নয়াগ্রাম। রামকৃষ্ণ মন্ডল ওরফে সনু যার নিজের বাড়ি বর্ধমান বয়স ২১ বছর বিবাহ সুত্রে থাকতেন শশুর বাড়ি ঐ নয়াগ্রামের ডাহিতে। ৮ মাসে র একটি পুত্র সন্তান আছে। মৃত্যুর তালিকায় আরও নাম আছে…যা এখনও আমরা যোগাড় করতে পারেনি। নিজেরা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ভুলে গেছেন মৃত সহকর্মীদের নাম। যেমনটা নমিতা মনেই করতে পারছেনা তাঁর স্বামীর সঙ্গে কাজ করা সেই কালাচাঁদ নামের তরুন ছেলেটির কথা যে ক’দিন আগেই মারা গেছে!
জঙ্গল মহলের একঝাঁক তাজা প্রান একটা একটা করে এভাবেই নিভে যাচ্ছে মারাত্মক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। দিন মজুর, মৎস্যজীবী পরিবারের ছেলেরা কাজের সন্ধানে পাশের পড়শি রাজ্যের জামসেদ পুরে ক্রাসারে কাজ নেয় দালাল মারফৎ। সাঁকরাইল থানার কদমডিহা গ্রামের গোবিন্দ জানা, নয়াগ্রামের নিমাইনগর রাইপড়িয়া গ্রামের মিলন পাত্র কিংবা সংসারে সাশ্রয়ের জন্য তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দেওয়া তাপস দণ্ডপাটরা তো রয়েছেই। আরও রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীর কাঞ্চন পুর ও দাঁতনের এক জন করে মোট তিনজন। কেশিয়াড়ীর পনশগঞ্জ বাসিন্দা বুদ্ধদেব দাস পিজি হাসপাতাল হয়ে দিল্লির এইমসে চিকিৎসায় ছিলেন। কেউ ভাল হয়না, হতে পারেনা। মৃত্যুই শেষ অবলম্বন।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী সিলিকোসিস রোগীদের পুরোপুরি সহায়তা করার কথা সরকারের। মৃতদের ক্ষতিপূরন পাওয়ার কথা। কিছুই কেউ পায়নি বা পাচ্ছেনা। রিপোর্ট তো হাসপাতাল থেকেই সরকারের ঘরে যাওয়ার কথা তারপর সরকারি আধিকারিকদের আক্রান্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা। কোথাও পরিবার গুলির অসহায়তা দেখতে না পেরে চিকিৎসকরাই পরামর্শ দিচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার। মামলা করলে চিকিৎসা বাবদ সমস্ত খরচ দিতে বাধ্য সরকার। কিন্তু কে যাবে ওই ঝামেলা পোহাতে? এমনিতেই রোগী নিয়ে নাজেহাল।
আর সেই যে বলা হয়েছিল, এরপর আর কাউকে ভিন রাজ্যে যেতে হবেনা কাজের জন্য ! কি হল কাজের? মানু্ষের বক্তব্য কাজ বলতে শুধুই ১০০দিনের কাজ যা আবার সব সময় মেলেনা। মুখ দেখে কাজ দেওয়া হয় আর কাজ পেলে বখরা দিতে হয় কখনও কখনও যাকে সোজা বাংলায় কাটমানি বলে। আর তা ছাড়া সাধারন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক ১০০দিনের কাজ করবে কেন? এমনটাও প্রশ্ন উঠেছে। ১০০দিনের কাজ তো সরকার বদলের আগেও ছিল! এই সরকার আসার আগে বলেছিল জঙ্গলমহলে যুবকদের কর্ম সংস্থান হবে। এলাকায় শিল্প হবে। তার কি হল ? কিন্তু উত্তর নেই।
ছেলেকে সমাধিস্থ করে সন্ধ্যার সুবর্নরেখায় চান করে উঠে আসে মঙ্গলের বাবা, মা, ভাই। সেই খই ছড়ানো পথে ফিরে চলে ঘরের পথে। সুবর্নরেখা বয়ে যায় একেকটা মৃত্যুর মতই।