জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৩৪
চিন্ময় দাশ
দামোদর মন্দির, আনন্দপুর (কেশপুর)
কেশিয়াড়ি আর আনন্দপুর– দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার দুটি বিখ্যাত বয়নকেন্দ্র। রেশম আর সুতি বস্ত্রের উৎপাদনে পারঙ্গম এই দুটি কেন্দ্র আর্থিক সমৃদ্ধির শিখরে উঠেছিল এক সময়। শত শত তন্তুবায়ের উদয় হয়েছিল এ দুটিতে। সেই সাথে অনেকগুলি বণিক পরিবারও। অনেকগুলি দেবালয় গড়ে উঠেছিল দুটি জায়গাতেই। তারই একটি আনন্দপুরের এই দামোদর মন্দিরটি।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করে যে নতুন জমিদারগণ পুরাতন জমিদারী কিনে জমিদার হয়েছিলেন, ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে যোগেশচন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে ৩ জন বিখ্যাত জমিদারের নাম বলেছেন– মেদিনীপুর শহরের জন্মেঞ্জয় মল্লিক, পলাশী গ্রামের নন্দী-বংশ এবং আনন্দপুর গ্রামে বাগ-বংশ. যোগেশচন্দ্র বলেছেন– ” এই তিনটি বংশ জাতিতে যথাক্রমে তাম্বুলী, তিলি এবং তাঁতী। স্বর্গীয় চৌধুরী জন্মেঞ্জয় মল্লিক ও পলাশীর স্বর্গীয় নবদ্বীপচন্দ্র নন্দী ও স্বর্গীয় অধরচন্দ্র নন্দীর এবং আনন্দপুরের শ্রীযুক্ত অনন্তচন্দ্র বাগের পূর্বপুরুষগণ ব্যবসায়ের দ্বারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন এবং তাঁহারাই এক সময়ে এই জেলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন।”
রেশমশিল্পের সুবাদে সমৃদ্ধ গঞ্জ হিসাবে গড়ে উঠেছিল আনন্দপুর। গঞ্জটি একসময় মেদিনীপুর শহরের চেয়েও বড় ছিল, এমন অভিমত পাওয়া যায়। বাগ ছাড়া, আরও কয়েকটি সম্পন্ন পরিবার ছিল এখানে। তাঁরাও কয়েকটি মন্দির রাসমঞ্চ, তুলসীমঞ্চ গড়েছিলেন।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আনন্দপুরে সেরা মন্দির দুটি। সরকারবংশের রঘুনাথ মন্দির আর বর্তমান আলোচ্য বাগ পরিবারের এই দামোদর মন্দির। দুটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে বাগ পরিবারের এই মন্দিরে। তা থেকে জানা যায়– ১. জনৈক পরীক্ষিৎ বাগ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২. ১৭৯০ শকাব্দ বা ইং ১৮৬৮ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
এই মন্দির পূর্বমুখী, পঞ্চ-রত্ন এবং ইটের তৈরী। সম্পূর্ণ বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১৬ ফুট ৯ ইঞ্চি, উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট। সামনের অলিন্দে ইমারতি থাম আর দরুণ খিলানের তিনটি দ্বারপথ। গর্ভগৃহে প্রবেশদ্বার একটি। দক্ষিণে একটি নিষ্ক্রমণ পথও আছে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ভারী বিশিষ্ট একটি উদাহরণ আছে প্রশস্ত গর্ভগৃহের পিছনের দেওয়ালে। সেখানে একটি ‘ প্রতিকৃতি আট-চালা মন্দির ‘। দ্বারপথের দু ‘পাশে দুটি দ্বারপালিকা মূর্তি। তারই কুলুঙ্গিতে দেবতার আসন পাতা।
পাঁচটি রত্ন। সবগুলোতেই পঞ্চ-রথ বিন্যাস। এবং গন্ডী অংশে পীড় রীতির প্রয়োগ হয়েছে।
প্রচুর টেরাকোটা ফলক আছে মন্দিরে। সামনের দেওয়ালে তিনটি বড় প্যানেল। এছাড়া, জোড়া কার্নিশের নিচে সমান্তরাল দুটি সারি এবং দুই কোনাচের লাগোয়া দুটি করে চারটি সারিতে।
পাঁচটি রত্ন। সবগুলিতেই পঞ্চ-রথ বিন্যাস। এবং গন্ডী অংশে পীড় রীতির প্রয়োগ হয়েছে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
প্রচুর টেরাকোটা ফলক আছে মন্দিরে। সামনের দেওয়ালে তিনটি বড় প্যানেল। এছাড়া, জোড়া কার্নিশের নিচে সমান্তরাল দুটি সারি এবং দুই কোনাচের লাগোয়া দুটি করে চারটি সারিতে। ফলকের মোটিফ মুখ্যত কৃষ্ণলীলা– বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলা, গোপিনীদের সাথে লীলা ইত্যাদি। পুতনা বধ, ধেনুর পাল, গোপবালক, নৌকাবিলাস — কতই না ফলক! বাদ্য সহযোগে শ্রীগৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দের সংকীর্তন, গৌরাঙ্গের পদতলে জগাই-মাধাইয়ের পতন উল্লেখ করবার মত। নজর করবার মত একটি মূর্তি আছে– বীণাবাদিনী সরস্বতীর।
প্রথামত গর্ভগৃহের দু’দিকে দ্বারপাল মূর্তি নাই। সেখানে রচিত হয়েছে একদিকে গরুড়, অন্যদিকে চতুর্ভুজ নটরাজ। দুটি দ্বারবর্তিনী মূর্তিও আছে মন্দিরে। মন্দিরের কারিগর– শ্রীরাম মিস্ত্রি এবং ভক্তারাম দাস মিস্ত্রি। উভয়ের নিবাস– রঘুনাথবাড়ি ও ইলামবাজার, চন্দ্রকোণা শহর।
মন্দিরে আর এক নিদর্শন গর্ভগৃহের পাল্লা দুটি। দারু-তক্ষণের উৎকৃষ্ট নিদর্শন এগুলি। সূত্রধর ছিলেন– রামধন কাঠুরা, নিবাস আনন্দপুর।
আকারে তেমন বড় নয় এই মন্দির। তবে অলংকরণ বৈভবে বেশ বড়। দর্শন করলে, হৃদয় মন তৃপ্ত হয়।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
সমীক্ষা সঙ্গী– শ্রী অভিজিৎ মন্ডল, আনন্দপুর।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর থেকে উত্তরে বাঁকুড়া গামী পথে গোদাপিয়াসাল। সেখান থেকে পূর্বে ৭/৮ কিমি দূরে আনন্দপুর। সরাসরি বাস আছে মেদিনীপুর থেকে। চন্দ্রকোণা, নাড়াজোল, কেশপুর থেকেও সরাসরি আনন্দপুর যাওয়া যায়।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
বন-জঙ্গল আর ছড়ানো ছিটানো গ্রাম পার হয়ে, প্রাচীন জনপদ আনন্দপুর। উত্তরে তমাল আর দক্ষিণে পারাং– দুই নদীর বেষ্টনীতে ঘেরা। সারা গ্রাম জুড়ে মাটিরই দো-তলা, তিন-তলা বিশাল বিশাল বাড়িতে বনেদি সব পরিবারের বসবাস। পাড়ায় পাড়ায় প্রাচীন দেবালয়, রাসমঞ্চ, রথতলা, মঠবাড়ি, রাজা-রানীদের স্মৃতিমাখা বিশাল সব দীঘি, জীর্ণ ঘাট– আরও কত কী। আনন্দপুরে একদিনের সফর স্মৃতির পাতায় উজ্বল হয়ে থাকবে বহুকাল।
প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস