নিত্য গুপ্ত: শুভেন্দু অধিকারীর পদ্ম শিবিরে যোগ দেওয়া কী কাল হয়ে গেল জঙ্গলমহলের বিজেপির জন্য? অন্ততঃ ঝাড়গ্রাম বিজেপিকে সেটা রীতিমত ভাবাচ্ছে। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরে তাঁর সভায় যে ভিড় হয়েছিল তা এতদিন যাবৎ স্থানীয় বিজেপির নেতাদের সভাতে হওয়া লোকের চাইতেও বোধহয় কম ছিল। এরপর গত মঙ্গলবার ঝাড়গ্রামে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি নাড্ডার সভার জন সমাগম এতটাই কম হয়েছিল যে নাড্ডা জনসভাই করেননি। তারপর বৃহস্পতিবার গোপীবল্লভপুরে সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রাক্তন বনমন্ত্রীর সভায় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে বিজেপিকে। নাড্ডার সভায় লোক না হওয়ায় ঝাড়গ্রাম বিজেপির যুক্তি ছিল সর্ব ভারতীয় সভাপতি দেরি করে আসায় সন্ধ্যার মুখে জনতা সভাস্থল ছেড়ে যায়। যুক্তির অবশ্য ঘাটতি হয়নি রাজীবের বেলাতেও। বিজেপি নেতারা জানিয়েছেন নাড্ডার রথযাত্রা এখন গোপীবল্লভপুর হয়েই
পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রবেশের পথে তাই তাঁর যাত্রায় সামিল হয়েছে জনতা যে কারনে রাজীবের সভায় তারা আসতে পারেনি।
এদিন গোপীবল্লভপুরের জগদ্ধাত্রী পুজোর মাঠে বিজেপির উদ্যোগে যে সভা আয়োজন করা হয়েছিল তার মূল বক্তা ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। হিসেব মত ওই মাঠ ভর্তি হওয়ার জন্য মাত্র ৫হাজার লোকই যথেষ্ট ছিল কিন্তু সেই পরিমান লোক তো দুরের কথা তার অর্ধেক লোকও হয়নি এদিন। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের পক্ষ থেকে জানা গেছে মেরে কেটে হাজার দুয়েক লোক হয়েছিল এদিনের সভায়। যে পরিমাণে জায়গা কর্মী সমর্থকদের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল তাতে হাজার পাঁচেক লোক হলে ভর্তি হওয়ার কথা মাঠটি। কিন্তু এদিন বিজেপির সভায় তার নেতাদের কাঙ্ক্ষিত জনসমাগম হয়নি। এদিন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তব্য রাখতে হয়েছে মাত্র হাজার দেড়েক কর্মী সমর্থকদের মাঝে।
এদিন সভায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তব্য রাখার আগে জনসমাগম কম হওয়ার কারণ হিসেবে বিজেপির জেলা সভাপতি সুখময় সৎপথি জানান, পরিবর্তন যাত্রার রথ যেহেতু থেমে থাকেনি,তাই অনেক কর্মী রথের সঙ্গে নয়াগ্ৰামের উদ্যেশে রওনা দিয়েছেন। এদিকে রাজীবের সভায় লোক না হওয়ায় উল্লসিত তৃনমূল শিবির। ঘাসফুলের আইটি সেলের সদস্যরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁকা মাঠের ছবি ছড়িয়ে মজা লুটেছেন সঙ্গে ক্যাপশন জুড়ে দিয়ে বলেছেন,’বিজেপির ফ্লপ সভা! ‘ কেউ কেউ আবার আরও খোঁচা দিয়েছেন, ‘বাংলায় পরিবর্তন নয় প্রত্যাবর্তন হবে।’ পাল্টা জবাব দিয়ে সম্মান রক্ষার মরিয়া চেষ্টা করেছেন বিজেপির সমর্থক কর্মীরাও। যদিও তৃণমূল কর্মীদের এইসব প্রচার এবং ফেসবুক পোষ্ট এর মধ্যে বিজেপি কর্মী এবং তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে বিকাল থেকে দেখা যাচ্ছে উত্তেজনাপূর্ণ কমেন্ট।
যদিও বিষয়টিকে এত হালকা করে দেখতে রাজি নন রাজনীতিজ্ঞরা। ঝাড়গ্রামে বিজেপির ভরা জোয়ারে মরা গাঙয়ের পেছনে এক অন্য কারন খুঁজছেন তাঁরা। তাঁদের মতে ২০১১পরবর্তী কালে বিজেপির ঘর ভরিয়েছিল বাম সমর্থকরা। জঙ্গলমহলে মাওবাদী পর্বে শতশত বাম কর্মীর খুন ও নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তাঁরা দায়ী করেছিলেন মাওবাদীদের সাথে তৃণমূলকেও কারন তাঁদের মতে ছত্রধর মাহাতের মত তৃণমুল কর্মীদের বানানো জনসাধারণের কমিটিই সামনে থেকে পুলিশকে আটকে পেছন থেকে মাও সন্ত্রাস ঘটাতে সাহায্য করেছিল। আর এই পর্বে জঙ্গলমহলে সামনের সারিতে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী যাঁকে আবার কিষানজী তৃনমূলের যুবরাজ বলে ঘোষণা করেন।
রাজনীতিকদের মতে মাওবাদীদের সন্ত্রাস শেষ হওয়ার পরই জঙ্গলমহলে বামপন্থী নেতা কর্মীদের ওপর নতুন অত্যাচার শুরু হয় তৃনমূল দল এবং সরকারের। প্রচুর ভুয়ো মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের ওপর পাশাপাশি বছরের পর বছর গ্রাম ছাড়া করা হয় বামপন্থী নেতা কর্মীদের। বামপন্থীদের মিছিল মিটিং করতে দেয়নি পুলিশ শুধু তাই নয় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতি থাকা স্বত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ কিংবা চাকরি কিছুই দেওয়া হয়নি মাওবাদীদের হাতে নিহত কিংবা নিখোঁজ পরিবারগুলির সদস্যরা। উল্টে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী বা জনসাধারণের কমিটির লোকেরাই সরকারের চাকরি ও পুনর্বাসন প্যাকেজ বাগিয়ে নেয় এমনটাই মনে করে জঙ্গলমহলের বামপন্থী পরিবার গুলিদের বেশিরভাগই।
কেন্দ্রের শাসকদলে থাকার সুবাদে এই সময় এই পরিবার গুলির পাশে দাঁড়ায় বিজেপি এবং তৃনমূলের অন্যতম শত্রু এই বিজেপিতেই দলে দলে ভিড়তে থাকেন বামপন্থীরা। পঞ্চায়েত আর লোকসভায় এঁরাই থলি ভরে দিয়েছে বিজেপির। আর তীব্র ঘৃনা পোষন করেছে শুভেন্দু অধিকারীর প্রতি। কারন সারা জঙ্গলমহলের বামপন্থীরা তাঁদের স্বজন হারানোর যন্ত্রনা আর নির্মম অত্যাচারিত হওয়ার দিন গুলির পেছনে কিষানজী আর শুভেন্দু অধিকারীকে সমান দায়ী মনে করেন। আর এটা সব চেয়ে ভালো জানেন শুভেন্দু অধিকারী যে কারনে এখন প্রতিটি সভায় তিনি এখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ভাল বলছেন, বলছেন বাম আমলে প্রতিবছর নিয়ম করে এসএসসিতে চাকরি হওয়ার কথা, বলছেন, সিঙ্গুর আন্দোলন বড় ভুল ছিল! কারন ঝানু রাজনীতিক শুভেন্দু অধিকারী বুঝেছেন বিজেপির থলে থেকে ওই ভোট বেরিয়ে গেলে শুধু বিজেপি নয় তাঁরও সঙ্কট।
রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন বিজেপিতে শুভেন্দু অধিকারী যোগ দেওয়ার পরই সম্বিৎ ফিরছে জঙ্গলমহলের সেই বামকর্মী সমর্থকদের যাঁরা তৃনমূল কংগ্রেস আর শুভেন্দুর বিরুদ্ধে সিপিএমের লড়ার আর ক্ষমতা নেই বলেই বিজেপিকে বেছে নিয়েছিলেন। আজ সেই বিজেপিতেই শুভেন্দু অধিকারীর যুক্ত হওয়া এবং বিজেপির তাঁকে সসম্মানে বরণ করে নেওয়া মেনে নিতে পারছেননা। তাই কী ঘরে ফিরছেন তাঁরা? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়ত আরও কিছুটা দিন সময় লাগবে। শুভেন্দু-নাড্ডা-রাজীবের সভায় লোক না হওয়ার পেছনে বিজেপি নেতাদের যুক্তিতে যদি সারবত্তা থাকে তবে ভালো কথা কিন্তু তা যদি না হয়?