Homeএখন খবরআনন্দদেব মুখোপাধ্যায়! শ্রদ্ধায়, স্মরণে

আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়! শ্রদ্ধায়, স্মরণে

নরেশ জানা: “দিঘায় রেল স্টেশন দিঘারই সর্বনাশের কারন হয়ে দাঁড়াবে। শুধু দিঘা নয় একদিন হয়ত রামনগরকেও গ্রাস করে ফেলবে সমুদ্র। পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে তুমি সমুদ্র সৈকতের এক কিলোমিটারের মধ্যে সাইকেল নিয়েই যেতে পারবেনা আর আমরা একটা স্টেশন বানিয়ে ফেললাম! পরিবেশ সচেতন দেশ গুলোতে সৈকতকে ভার্জিন রাখার জন্য মানুষ জন সৈকতের ১ কিলোমিটার আগেই সমস্ত যানবাহন রেখে পায়ে হেঁটে সমুদ্র স্নানে যায়। আমরা সৈকতে দু হাত দিয়ে বালি খুঁড়ি, ঘোড়া ছোটাই এমনকি বীচ ড্রাইভ করি আর এভাবেই প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সমুদ্রের সর্বনাশ করি আবার আমরাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সরকারকে গাল পাড়ি, ভাঙন রোধে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা? অথচ অন্য দেশে বীচে একটা আঁচড় কাটা যায়না। “মোবাইলে হঠাৎই মাঝে মধ্যে স্যারের ফোন আসে, “আমি দিঘা যাচ্ছি, তুমি কী আসবে? নাকি ফোনেই চিরকাল ইন্টারভিউ নিয়ে যাবে হে রিপোর্টার?” যাব বললেই যাওয়া যায়না। হেড অফিসের পারমিশন ছাড়া স্টেশন ছাড়ি কী করে। তখন দ্য টেলিগ্রাফের বেঙ্গল ডেস্ক সামলান শুভ্র রায়, মাথার ওপর ববিদা, সৌমিত্র ব্যানার্জী। শুভ্রদা বলল, ‘ক’দিনের ম্যাটার? স্পট ম্যানেজ করে নেবে তো?” আন অফিসিয়ালি ছুটি মঞ্জুর। খড়গপুর-দিঘা বাস ধরেই ফেলি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রই নই তো সমুদ্র বিজ্ঞান! কিন্তু আমাকে হাতে ধরে সমুদ্র বোঝাতেন। দিঘার সেচ বাংলোয় স্যারের সঙ্গি হত কখনও শ্যামল সেন (তখন গণশক্তিতে শ্যামল) কখনও আমি। স্যার বলছেন, “সমুদ্রের সাত আট কিংবা দশ কিলোমিটার দূর অবধি যে উঁচু নিচু ক্ষেত্র দেখছ এসবই হল বালিয়াড়ির অংশ যাকে আমরা বলছি ডিউন। সমুদ্র ঘেঁষে সৈকতের প্রান্ত থেকে শুরু করে ওই কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত যে ডিউন তাকে কেটে রেল লাইন হয়েছে। প্রকৃতির তৈরি করা মৃত্তিকা সংবন্ধন ধ্বংস করা হচ্ছে। কেন স্টেশনটা রামনগরে থামিয়ে দেওয়া যেতনা? ওখান থেকে পর্যটকরা দিঘায় আসতেন। স্থানীয় মানুষরা পরিবহন পরিষেবা দিয়ে উপার্জন করতে পারতেন আবার সমুদ্র বিপজ্জনক হয়ে উঠতনা।”

তখন আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় দিঘা উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান। কাজ পাগল মানুষটির মাথায় তখন দিঘা ভর করে আছে। আমাদের বলছেন, ‘লেখ, লেখ। তোমরা না লিখলে লোকে জানবে কী করে? যাঁরা বেড়াতে আসে তাঁরা আরও স্বাচ্ছন্দ্য চাইবে। তুমি কোনও দিনই তাঁদের অভাব পূরণ করতে পারবেনা কিন্তু মনে রাখতে হবে সমুদ্রের টানেই তাঁরা সৈকতের জন্যই তাঁরা আসেন। এই সৈকতকে যদি বাঁচানো না যায় তাহলে কেউ দিঘায় কেউ আসবেনা।’ দিঘার সৈকতের ৫০০মিটারের মধ্যে সমস্ত নির্মান ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন স্যার। লড়াই গড়িয়েছিল আদালত অবধি। আদালত রায় দিল ৫০০ মিটারের মধ্যে সমস্ত নির্মান ভেঙে ফেলতে হবে কিন্তু সরকার তা শেষ অবধি কার্যকর করে উঠতে পারেনি বা ইচ্ছা করেই করেনি। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটায় জোরালো প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক। ২০০৮ সালের এক মার্চ মাসে স্যারকে দিঘায় হেনস্থা করার চেষ্টা হল। বলতে দ্বিধা নেই বর্তমান শাসকদলের লোকেরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই পরিকল্পনার। সেবার আমি ছিলামনা স্যারের সঙ্গে, শ্যামল ছিল। আগাম খবর পেয়ে দুপুরে দিঘা ছেড়ে চলে আসেন স্যার । আর এখন দিঘায় যা হয়েছে বা হয়ে চলেছে তা তো কংক্রিটের জঞ্জাল। সৌন্দর্যায়নের এই মূল্য দিঘাকে কী ভাবে দিতে হয় সেটা ভবিষ্যৎই বলবে।

দিঘা নিয়ে স্যারের অজস্র ভাবনা আর সেই কারনে নিজের সঙ্গে জুটিয়ে নিতেন আরও গবেষকদের। স্যার নিজেও যেমন ভূ-বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি দিঘা নিয়ে ভাবনার কাজে যুক্ত করেছিলেন প্রখ্যাত সমুদ্র গবেষক তথা বিজ্ঞানী গৌতম সেনকে। প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে দিঘার ভাঙন রোধ কী ভাবে করা যায়, কত বেশি করে প্রকৃতিকে ব্যবহার করা যায় সেই নিয়ে ভেবেছেন। বলতেন, ” তোমার যদি শক্তি থাকে তবে তোমার সামনে যত বড় বাধা আসবে তুমি তার চেয়েও বড় শক্তি দিয়ে তুমি তাকে ভাঙার চেষ্টা করবে এটাই হচ্ছে সিম্পল সায়েন্স। তুমি যত বড় বাঁধ দেবে ভাঙনের অভিঘাত তত বেশি তোমাকে সহ্য করতে হবে বরং ভাল তুমি সমুদ্রকে খেলতে দাও প্রকৃতির সাথে। ঝাউয়ের গাছ, ম্যানগ্রোভ অরন্য ইত্যাদি বাড়াতে হবে।”

ভাঙন নিয়ন্ত্রনে স্যারের শেষ উদ্যোগটা ছিল জিও-গার্ড। ওরকমই একদিন ফোন এল, দিঘায় যাচ্ছি। চলে এসো। একটা নতুন কাজ শুরু করেছি। ফের শুভ্রদাকে ফোন। শুভ্রদা বললেন, ‘দেখো একটা স্টোরি নামাতে পারো কিনা!’ ছুটলাম দিঘা। সমুদ্রে বন্ধনে লাল কালো পাথর নয়, বালির বস্তা নয়। সিনথেটিক টিউব! বিশালাকার সেই সব টিউব প্রতিস্থাপন করা হবে সমুদ্রের কিনারা বরাবর, মাইলের পর মাইল। জল যত উঁচু হবে তারই মাথায় ভেসে সেই টিউব তারও চেয়ে উঁচু হয়ে যাবে। ফলে উপচে পড়ে জল গ্রামে ঢুকতে পারবেনা। আমি আর স্যার হাঁটছি সমুদ্রের কিনারা বরাবর, মাইলের পর মাইল। পরে ওড়িশা সরকার স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওড়িশা উপকূলের ভাঙন রোধের পরিকল্পক হিসাবে। এখন শুনছি সে রাজ্যের কেন্দাপাড়া এলাকায় এই জিও-গার্ড প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে।

মানুষকে, প্রকৃতিকে এত নিবিড় ভালবাসা আমি খুবই কম দেখেছি আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের বাইরে। আর অকপট। কোনও রাখ ঢাক নেই। বামপন্থী আপাদমস্তক কিন্তু ধামাধরা নন। বিদ্যসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার তখন উপাচার্য। সেই সময় স্থানীয় শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে তীব্র মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল স্যারের। কিন্তু টলানো যায়নি তাঁকে। সহজ সরল অনাড়ম্বর কিন্তু প্রখর আত্মমর্যাদা বোধ। সময়কে ব্যবহারের বেলায় তিনি একদম কাঁটায় কাঁটায়। সময়ের অপচয় একদম বরদাস্ত করতেননা। খড়গপুর ভগৎ সিং জন্ম শত বার্ষিকী কমিটির বাৎসরিক উৎসব ও মেলায় উদ্যোক্তারা ঠিক করলেন উদ্বোধনে স্যারকে আনবেন সঙ্গে নাট্য ব্যক্তিত্ব শোভা সেন। আমার ওপর ভার পড়ল। দুজনের সঙ্গে কথা বলে রাজি করালাম। দুই প্রনম্য মানুষ! ঠিক হল কলকাতা থেকেই গাড়ি দুজনকে বাড়ি থেকে তুলে আনবে। একজন গেলেন খড়গপুর থেকে তাঁদের আনার জন্য। কলকাতা থেকেই গাড়ি ভাড়া করা হল। স্যারকে সময় দেওয়া হল বেলা ২টা। প্রথমে শোভা সেনকে তুলে গাড়ি স্যারকে তুলে আসবে। কিন্তু শোভা সেন অসম্ভব দেরি করলেন তৈরি হতে। স্যারের কাছে গাড়ি পৌঁছালো ২ঘন্টা পরে। স্যার ততক্ষনে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করে করে পোশাক পরিবর্তন করে নিজের কাজে বসে পড়েছেন। স্যারকে রাজি করানো গেলনা। উদ্যোক্তারা আমাকে ফোন করলেন। আমি আর স্যারকে ফোন করিনি। আমি জানি স্যারের না মানেই না। কয়েকদিন পরে স্যারকে ফোন করে ক্ষমা চাইলাম। স্যার বললেন, “আমি ওদের জন্য যাতায়ত ইত্যাদি ৮ ঘন্টা বাজেট রেখেছিলাম নরেশ। আমি ভেবেছিলাম সারা সপ্তাহ ধরে কিছুটা কাজের সময় বাড়িয়ে ওই আটঘন্টা মেক আপ করে নেব কিন্তু ১০ঘন্টা মেক আপ করতে পারতামনা। তাই গেলামনা।”

স্যারের সঙ্গে আলাপ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়েই। স্যার উপাচার্য হয়ে আসার কয়েক মাস পর একটা সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম। ৩০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন। এই ঝাঁকা মাথা চুল তখন কালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা মূলক কাজ নিয়ে স্টোরি করতে চাই বলায় সমাজ বিদ্যার এক অধ্যাপককে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন। আসার সময় ধরিয়ে দিলেন দুটো বিদেশি ম্যাগাজিন। এই পাওনাটা আমার শেষ অবধি থেকেই গেল। বিশ্ব বিদ্যালয়, দিঘা, যাদবপুর যেখানেই গেছি সব শেষে তাঁর দেওয়া একটি বা দুটি জার্নাল অথবা বই নিয়ে বাড়ি ফেরা।
২০০৮, সালটার শেষের দিকে লালগড় আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীন হয়ে গেল। ২০১১ থেকে আবার যোগাযোগ শুরু। ফোন করলেই বাড়ির সবার খবর নিতেন। যাদবপুরের আমার বন্ধু দেবাশিস রায়ের একটা নাটকের দল রয়েছে যাদবপুর ব্যতিক্রম বলে। ওর ওখানে গেলে মাঝে মধ্যে স্যারের কাছে যাওয়া। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের অফিসে স্যার বসতেন নিয়মিত।

তারপর শেষ দেখা এ বছর জানুয়ারিতে হলদিয়ায় বিশ্ব বাংলা সাহিত্য উৎসবে। সেবার গল্পকার হিসাবে আপনজন সম্মাননা নিয়েছিলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে। মঞ্চে সাহিত্যিক নলিনী বেরা আর স্যার। স্যার এসেছিলেন বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্ম বার্ষিকীর ওপর বক্তৃতা রাখতে। অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চের পেছনে আমি শ্যামল আর কমল ( কমল বিষয়ী, আপনজন) স্যারকে নিয়ে বসে গেলাম আড্ডায়। উৎসবে এলাহি খাবার ব্যবস্থা কিন্তু স্যারের চাই মুড়ি। হাতে এক ঠোঙা মুড়ি নিয়ে স্যার বলছেন আর আমরা শুনছি। ফিরে ফিরে সেই দিঘার কথাই। স্যারকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম আমরা। কলকাতা ফিরে ফোন করে যথারীতি জানিয়েছিলেন পৌঁছে যাওয়ার কথা। উৎসবের সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল করোনা। আর যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। বৃহস্পতিবার, ৮ই অক্টোবর! স্যার চলে গেলেন সেই করোনাতেই। দু’দিন আগেই কমল স্যারকে ফোন করেছিল কিন্তু সুইচ অফ ছিল। তখনও আমরা বুঝতে পারিনি ও সুইচ আর অন হবেনা কোনোও দিনও।

RELATED ARTICLES

Most Popular