নিজস্ব সংবাদদাতা: ফের মানুষের বানানো ‘ডাইনি’র খোঁজ মিলল পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায়। গত ২দিন ধরে সালিশির নাম করে তীব্র অত্যাচার চলার পর কোনও রকমে পালিয়ে বেঁচেছেন আক্রান্ত মহিলা। আতঙ্কের ছাপ ওই পরিবারের চোখে মুখে। ঘটনায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ডেবরা থানায়। যদিও ঘটনায় এখনও অবধি গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে নির্যাতিতা মহিলার নাম চাঁদমনি মুর্মু।
বাড়ি ওই থানার লোয়াদা গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার ভূইঁয়াবসান গ্রামে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে চাঁদমনি এবং তাঁর স্বামী সনাতন পেশায় দিন মজুর। সামান্য খাসের জমি রয়েছে ওই সন্তানহীন দম্পত্তির। ভূইঁয়াবসান গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় শ’খানেক পরিবার রয়েছে। ওই এলাকায় কয়েক বছর আগে একটি গরু মারা যায়। তারপর থেকেই সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয় এই স্বামী-স্ত্রীকে। গত চারবছরে অসুখ বিসুখে মৃত মানুষদেরও দায় চাপানো হচ্ছিল এই পরিবারটির ওপরেই।
সনাতন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার থেকেই হঠাৎ-ই গ্রামের পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল না। তখনই খারাপ লক্ষণ পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছু একটা হতে চলেছে
আমাদের সাথে। গ্রামের কিছু মানুষ ঘোরা ফেরা করছিল বাড়ির আশেপাশে। এবার বুঝতে পারি নজরদারিতে রয়েছি আমরা। ঠিক করেছিলাম সন্ধ্যা হলে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালাবো কিন্তু ততক্ষনে ওরা ঘিরে নিয়েছিল আমাদের বাড়ি। তারই মধ্যে স্বামী-স্ত্রী মিলে বাড়ির পেছন দিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পালাতে পারিনি।”
ওই দিন রাতভর ২জনকে বাড়ি থেকে তুলে এসে শুরু হয় সালিশি। মোড়লরা জানায় যে, তারা তাদের ‘জানগুরু’ বা গুনিনের কাছে গিয়েছিল। জানগুরুই জানিয়েছে যে সনাতন ও চাঁদমনিই ডাইনি। এবং নিদান দেওয়া হয়, গ্রাম ছাড়তে হবে। মানতে চাননি ওই দম্পত্তি। এরপরই শুরু হয় মার। এরপর ভোর রাতে সবাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে আর তারই মাঝখানে সালিশি সভা থেকে পালানোর চেষ্টা করেন ২জন। উদ্দেশ্যে ছিল আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার। এবার সনাতন পালাতে পারলেও ধরা পড়ে যান চাঁদমনি।
চাঁদমনি বলেন, ‘ দ্বিতীয়বার মারধরের আগেই আমরা পালানোর চেষ্টা করি। ইচ্ছা ছিল বাপের বাড়ি যাব কিন্তু ওরা আমাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। আমাকে তুলে আনা হয় ফের গ্রামে। ফের শুরু হয় মারধর। সন্ধ্যে পর্যন্ত চলে দফায় দফায় মারধর। মারের সময় ওরা একটা কথাই বলছিল, আমাদের গ্রাম ছাড়তে হবে। না’হলে মেরে পুঁতে দেবে আমাদের। বলছিল আমরাই নাকি গরু আর মানুষ গুলোকে খেয়ে ফেলছি।’ এদিকে গ্রামবাসীদের একাংশের কাছ থেকে ঘটনার কথা জানতে পারে পেয়ে গ্রামে সিভিক ভলান্টিয়ার। তাঁদের মাধ্যমেই খবর যায় ডেবরা থানায়। ছুটে আসে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় চাঁদমনি কে। শনিবার সকালে ডেবরা হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডেবরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন চাঁদমনি।
উল্লেখ্য ৩দিন আগেই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছে জানা যায়, ২০১৬ সালে থেকে ডাইনি সন্দেহে ব্যাপক মারধরের পর সপরিবারে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে গিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে এক শিক্ষক পরিবারকে। মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরে মেদিনীপুর সদর ব্লকের খালডাঙ্গী গ্রামের ঘটনায় পুলিশও ব্যর্থ হয়েছে তাঁদের বাড়িতে স্থিত করতে। সেই ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসন নড়েচড়ে বসার মাঝখানেই ফের এই ঘটনা। বছর ছ’য়েক আগে এই ডেবরা লাগোয়া দাসপুর থানা এলাকায় ডাইনি সন্দেহে মেরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল ৩ মহিলাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত শত্রুতা অথবা সম্পত্তি দখল কিংবা মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা আদায় করার উদ্দেশ্যে নিয়েই ঘটনাগুলি ঘটে থাকে বলেই পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে।