Homeএখন খবরউনুন ধরেনি গোটা গ্রাম জুড়ে, উনুন আজ শহীদের চিতা-ই! বুক ফাটা কান্নায়...

উনুন ধরেনি গোটা গ্রাম জুড়ে, উনুন আজ শহীদের চিতা-ই! বুক ফাটা কান্নায় মায়ের আকুল আবেদন, ‘আবার ফিরে আসিস বুম্বা’

নরেশ জানা: পথ ঘাট খাল বিল ভেঙে নারী পুরুষ শিশু যুবক যুবতী বৃদ্ধ ছুটছে ভোর থেকেই, সবারই ঠিকানা আজ সবং, সাকিন সিংপুর গ্রাম। ভেঙে পড়া ভিড়ে শহীদের গ্রাম সিংপুরে রবিবার নেই করোনার ভয়, ভেঙে খান খান সামাজিক দূরত্ব, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে আজ, রবিবার! এ ফেরা বড় নির্মম, নির্দয়, কফিনে শুয়ে জাতীয় পতাকায় মুড়ে, এ কেমন ফেরা?

তবুও যে ফেরা, শেষবার! তাই শুধু সবং নয়,মানুষ এসেছেন ওপারের জেলার পটাশপুর, লাগোয়া নারায়নগড়, পিংলা, খড়গপুর গ্রামীন এলাকা থেকেও। পিলপিল করে মানুষ ছুটছে বীর সৈনিক শহীদ হয়ে যাওয়া ঘরের ছেলে শ্যামলের মুখটা একবার দেখতে।

ওদিকে প্রায় আড়াই বেলা উনুন জ্বলেনি সিংপুর গ্রামে, পুরোপুরি অরন্ধন। আজ গ্রামে শুধু এক জায়গাতেই আগুন জ্বলবে। সে আগুনে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে শহীদ শ্যামলের নশ্বর দেহ। আজ খিদে নেই, তৃষ্ণা নেই, আজ শুধুই কান্না। মাও যেন আজ ভুলে গেছে দুধের শিশুকে স্তনপান করতে। বর্ষায় ঝোপ জঙ্গল জমে গেছে রাস্তার ধারে, সিংপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাশে।

শনিবারই গ্রামের ছেলেপুলেরা ঝোপ জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে রেখেছে, শ্যামল আসবে, শ্যামলকে দেখতে লোকও আসবে তাদের জন্য রাস্তা অমসৃণ করে রাখা দরকার। ঘড়ির কাঁটা ধরে শ্যামলের কফিনবাহী সাঁজোয়া শকট পৌঁছে গেল সিংপুর প্রাথমিক স্কুলের মাঠে। আর তখনই কান্নায় ভেঙে পড়ল সমগ্র জনতা । বন্দেমাতরম, ভারত মাতার জয়, অমর শহীদ তোমায় আমরা ভুলছিনা শ্লোগানে কেঁপে উঠল জনপদ।

১৬৯নম্বর সিআরপিএফের জওয়ানরা সযত্নে সেই কফিন নামিয়ে রাখলেন আগে থেকে নির্মিত মঞ্চে। মঞ্চের পাশে শহীদ পরিবারের বসার ব্যবস্থা, অন্য দিকে ভিআইপি। পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা শাসক, খড়গপুর মহকুমা শাসক, বিধায়ক, দুই সাংসদ, একাধিক কর্মাধ্যক্ষ হাজির। তাঁদের মাল্যদানের পাশাপাশি মালা দিতে এসেছিলেন জেলার প্রাক্তন পুলিশ সুপার তথা বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষ। জড়ো হয়েছেন সবংয়ের অবসর প্রাপ্ত সেনা জওয়ানরা।

সাড়ে ৯টা সিআরপিএফে জওয়ানদের কাঁধে চড়ে শ্যামলের দেহ গেল সেই প্রিয় বাড়িটাতে। মায়ের জন্য এই বাড়িটাই তৈরি করেছিলেন শ্যামল। বাবার সঙ্গে এই বাড়ির কথা বলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই জঙ্গী হামলায় মৃত্যু হয় শ্যামলের। কফিন নামল বাড়ির সামনে। মা একবার ছেলের মুখ দেখতে চান যে! অনেক বোঝানো হল মাকে কিন্তু নাছোড়বান্দা মা, একটি বার প্রিয় সন্তানের মুখ দেখবেন।

কফিন ঢুকল বাড়ির ভেতরে, কফিন খুলল, মা আছড়ে পড়লেন দেহের ওপর। হাত বুলিয়ে দিলেন গোটা শরীরে, “কোথায় লেগেছে তোর? বল মানিক আমার, আমার চাঁদ! আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি……” মা কেঁদেই চলেন। কফিন বন্ধ হয়ে এবার বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দুরে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই সাজানো চিতায়।

আগেই দেওয়া হয়েছিল গার্ড অব অনার, সেই মঞ্চের সামনে এবার লাস্ট পাশ। বন্ধুক ওপরে তুলে নিচে নেমে গেল সঙ্গী জওয়ানদের। অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ সেনানি। কফিনের ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হল জাতীয় পতাকা। গর্জে উঠল একসাথে সমবেত বন্দুক। সমাধিতে স্থাপিত হল বীর জওয়ানের দেহ। আগুন হাতে বাবা। মায়ের বুক ভাঙা কান্নায় শোনা গেল শহীদ সন্তানের কাছে চিৎকার করে বলছেন, ‘আরও একবার ফিরে আসিস বুম্বা, অভাগিনী মায়ের কাছে।’ সিংপুর জানত কিন্তু সবং জানতনা, শ্যামলের ডাক নাম বুম্বা, মায়ের আদরের বুম্বা। ততক্ষনে চিতা জ্বলে উঠেছে।

RELATED ARTICLES

Most Popular