সুবর্ণরেখার কথা-১ ( আমাদের কথা-সাবেক বাংলা বিহার উড়িষ্যা বা সুবা বাংলা জুড়ে থাকা নদীটির নাম সুবর্ণরেখা। এ নামের কারন নিয়ে অনেক মুনির অনেক মত। সে আলোচনার বাইরে গিয়ে এই পর্বে অন্য কথা। বর্তমানের ঝাড়খন্ডে উৎপত্তি আর ওড়িশায় মোহনা চুম্বন নদীটির মধ্যবর্তী পর্ব পশ্চিমবঙ্গে বহমান। শতশত বছর ধরে বয়ে যাওয়া এই নদী উপত্যকায় সৃষ্ট জনপদগুলির কথা এবং কাহিনী নিয়ে কলম ধরেছেন প্রাবন্ধিক উপেন পাত্র। প্রান্তবাসীর সংস্কৃতি চর্চায় নিবিষ্ট উপেন পাত্র কয়েকশ প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র রচনা করেছেন। নিজেও বাস করেন সুবর্ণ রৈখিক জনপদে। তাঁর সেই নদী ভিত্তিক নিবিড় যাপন থেকেই খুঁজে চলেছেন সুবর্ণরেখার কথা, উপকথা। তাই নিয়ে দ্য খড়গপুর পোষ্টের নতুন ধারাবাহিক ‘সুবর্ণরেখার কথা।’ এই পর্বে লেখক সুবর্ণরেখার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় রাখছেন। পরবর্তী পর্যায় থেকে শুরু হবে কথা উপকথা।
দ্য খড়গপুর পোষ্ট ইতিমধ্যেই দুটি ধারাবাহিক প্রকাশ করেছে বা করে চলেছে। শুভঙ্কর দত্তের কুম্ভ কথা আজও পাঠকের আক্ষেপ, দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য। অন্যদিকে চিন্ময় দাশের প্রকাশিত হয়ে চলা জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসী বাঙালিরও প্রশংসা কুড়িয়ে চলেছে। সেই আবহে আমাদের এই নতুন ধারাবাহিক। প্রাবন্ধিক উপেন পাত্রকেও আমাদের জন্য এই ধারাবাহিক লিখতে অনুরোধ করেছিলেন চিন্ময় দাশই। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। লেখক উপেন পাত্রকেও আমাদের অভিনন্দন কৃতজ্ঞতা। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিতব্য এই ধারাবাহিকের প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমাদের প্রিয় শিল্পী বন্ধু রামকৃষ্ণ দাস। তাঁকেও অভিনন্দন। মাত্র কয়েকঘন্টার অনুরোধেই কাজটি করে দিয়েছেন তিনি। আমরা নিশ্চিত এই ধারাবাহিক পাঠক পাঠিকাদের ভাল লাগবে। বিনীত, সম্পাদক)
সুবর্ণরেখা নদী-এক বহমান সংস্কৃতি উপেন পাত্র নদীমাতৃক দেশ কথাটি বহুল প্রচারিত।সুবর্ণরেখা নদী এক মিশ্র ভাষা-সংস্কৃতির মাতৃস্বরূপা।এটি আন্ত:রাজ্য নদী।ঝাড়খণ্ড রাজ্যে জন্ম হয়ে,বাংলার মধ্য দিয়ে, ওড়িশায় গিয়ে বঙ্গ উপসাগরে পড়েছে।সুবর্ণরেখা একক নদী,কারো উপনদী নয়,এর কোন শাখানদীও নেই।অতীতে নদীতে স্বর্ণরেনু পাওয়া যেতো,তাই নদীর নাম সুবর্ণরেখা।হিন্দীভাষীরা বলে স্বর্ণরেখা।
রাঁচির অদুরে এক কূপ উৎস থেকে নদীর জন্ম।উৎস থেকে টাটা পর্যন্ত নদী শীর্ণকায়া।বাংলা সীমান্তের ষাটিদহ,ষাট হাত পরিমান জল জল আছে এই অর্থে,পর্যন্ত নদীর উচ্চগতি।নদীর উচ্চগতি বড়ই মনোরম।ষাটিদহ থেকে রোহিণী পর্যন্ত নদীর মধ্যগতি।সুবর্ণরেখার একমাত্র উপনদী ডুলং নদী এখানে খুদিপালে মিলিত হয়েছে,যা এক রম্য পর্যটন স্থল।বাংলার ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সীমান্ত বরাবর গিয়ে সুবর্ণরেখা নদী ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় প্রবেশ করেছে।
ঘাটশিলা থেকে বাংলা ভূভাগ অংশ অতীতে ওড়িশার ওড্রভুক্তির মধ্যে ছিল।শ্রীজীব গোস্বামীর নির্দেশমতো শ্যামানন্দ আচার্য ওড়িশাতে গোড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেন।তিনি মহাপ্রভুর ঝারিখণ্ড পথ অনুসরণ করে বিষ্ণুপুর থেকে যাত্রা শুরু করে সুবর্ণরেখা তীরে ঘাটশিলাতে এসে পৌঁছান।বাঁকুড়া ও বর্দ্ধমান জেলার বহু তীর্থযাত্রী তাঁর সহগামী ছিল।ঘাটশিলা থেকে নদীর নিম্নগতি ধরে দাঁতন গিয়ে জগন্নাথ সড়ক ধরে পুরী যাওয়া মনস্থ করেন।কিন্তু মধ্যবর্তী গোপীবল্লভপুরে এসে মত পরিবর্তন করেন এবং এখানে “শ্রীপাট” প্রতিষ্ঠা করেন এবং রোহিনীর রসিকানন্দকে শ্রীপাটের প্রথম মোহান্ত গোস্বামী রূপে অভিষিক্ত করেন।
বাঁকুড়া ও বর্দ্ধমান জেলা আগত তীর্থযাত্রীরা এই উর্বরা নদী অববাহিকায় বসতি করে। পরে শ্যামানন্দের জন্মস্থান ধারেন্দা সংলগ্ন কাঁসাই তীরস্থ বহু ভক্তজন এখানে এসে বসতি করে।শ্যামানন্দের এক শিষ্য রসময় ঘোষ,বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করায় পদবি হয় দাস অধিকারী,তাঁর জেষ্ঠপুত্র গোপীজনবল্লভ দাস রসিকানন্দের জীবনচরত “রসিকমঙ্গল” কাব্য লেখেন।অধিকারী পদবিধারী তাঁর বংশধরগণ এখনও এই গোপীবল্লভপুরে বসবাস করেন।রসিকমঙ্গল কাব্যটি দুষ্প্রাপ্য ছিল,সম্প্রতি রণজিতপুর রামনারায়ণ পাঠাগারের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আজহারউদ্দীন খান মহাশয়ের সম্পাদনায় “শিকড়ের খোঁজে” পুস্তকে কাব্যটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।ওড়িশার অংশ হলেও এখানে বাংলা ভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং এখানে এক মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।এখানে প্রচলিত লোকভাষাটিকে সুবর্ণরৈখিক লোকভাষা বলা হয়।এই লোকভাষার সাথে আদি-মধ্য বাংলার সাদৃশ্য আছে।বড়ু চণ্ডীদাস এই ভাষাতে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” রচনা করেন। ড: সুধীর কুমার করন মহাশয়ের গবেষণা থেকে জানা যায়– সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকা অঞ্চল দীর্ঘকাল বহির্জগৎ থেকে আপাত বিচ্ছিন্ন থাকায় অতীতের আদি-মধ্য বাংলা এখানে প্রায় অবিকৃত ভাবে রয়ে গেছে।
একদা ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত থাকায় ১৯২৯ সালে ওড়িশা এই অঞ্চলকে ঐ রাজ্যের মধ্যে দাবি করে। বাংলা-ওড়িশা বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং বিবাদ নিরসনের জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন, জডওয়েল স্যামুয়েল কমিশন,গঠিত হয়।ওড়িশা পক্ষের ব্যারিস্টার ছিলেন উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গোদাবরীশ মিশ্র এবং বাংলা পক্ষের ব্যারিস্টার ছিলেন মেদিনীপুরের মুকুটহীন রাজা দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।তাঁর দাখিল করা নথিপ্রমানের ওপর ভিত্তি করে কমিশন বাংলার পক্ষে রায় দেয়।
সুবর্ণরেখা নদীতে স্বর্ণরেনু পাওয়ার মতো,নদীতে একদা সুস্বাদু ইলিশ মাছ পাওয়া যেতো।খাদ্যরসিকেরা যার সাথে পদ্মার ইলিশের তুলনা করতেন।বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে দু’টি,বাংলায় একটি ও ওড়িশায় দু’টি নদীবাঁধ নির্মাণের কারণে এবং কলকারখানা জাত বর্জ্যের কারনে ঐ ইলিশ শুধু এক নস্টালজিক ইতিহাস।