নিজস্ব সংবাদদাতা: দক্ষিন ২৪পরগনার মথুরাপুর কৃষ্ণচন্দ্র হাই স্কুলের শিক্ষক চন্দন কুমার মাইতি সন্ধ্যার সময় ‘ দ্য খড়গপুর পোষ্ট’কে জানালেন, ” সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই আর থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা। আমি প্রায় দু’দশক রয়েছি এখানে। সুপার সাইক্লোন, আইলা,বুলবুল,ফণী সব দেখেছি। কিন্তু আমফানের মত প্রলয়ঙ্করী ঝড় দেখিনি। আমরা এখনও বুলবুলের ক্ষতিই কাটিয়ে উঠতে পারিনি তার মধ্যে এই আমফান কার্যত কোমর ভেঙে দিয়ে গেল। এ জেলা আর উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ।” পেশায় শিক্ষক কিন্তু আপাদমস্তক সমাজসেবী। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে যাওয়া কিশোরীদের উদ্ধার করে হোস্টেলে রেখে পড়ান।কাশ্মীরে চালান হয়ে যাওয়া কন্যাকে ফিরিয়ে এনে হোস্টেলে রেখে ফিরিয়ে দেন স্বাভাবিক জীবন।বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় কিন্তু সপরিবারে থাকেন স্কুলের গায়েই।মোটর বাইকে চষে বেড়ান প্রত্যন্ত এলাকায়। আমফানের তান্ডবে দক্ষিন ২৪ পরগনার জন্য কান্না ঝরে পড়ে তাঁর গলায়। স্কুলের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছেন সবার জন্য। তাঁর কাছেই খবর পাওয়া যায় মাটিতে মিশে গেছে জেলাটা।
ঠিক একই কথা শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেও। বললেন কার্যত শেষ হয়ে গেছে দুটো জেলাই, উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনা। নবান্নে রাত সওয়া ন’টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সব সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। দুই চব্বিশ পরগনা পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে সব নদীবাঁধ। কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আন্দাজ করা যাচ্ছে না।”
সন্ধ্যাবেলায় দিঘায় দাঁড়িয়ে রাজ্যের সেচ ও জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী জানালেন, কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের একাংশ। আমফানের দাপটে একের পর এক নদী বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলিংহাম, উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পাথরপ্রতিমার জি প্লট, সাগরের মৌসুনি আইল্যাণ্ডের একটি বাঁধ, নামখানার একটি বাঁধের তিনটি পয়েন্ট এবং ক্যানিংয়ে মাতলা নদীর উপর একটি বাঁধের দুটি পয়েন্ট ভেঙে জল ঢুকে গিয়েছে গ্রামে। কোথাও ৩০ মিটার, কোথাও আবার ৫০ মিটার পর্যন্ত বাঁধ ভেঙেছে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে।
অনেকের আশঙ্কা, সারা রাত জল ঢুকতে থাকলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। নারায়ণপুর এবং কচুবেড়িয়ায় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেটিও। কার্যত লণ্ডভণ্ড অবস্থা দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায়।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম, কাঁথি, দিঘা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নামখানা, কাকদ্বীপ, গোসাবা, বাসন্তী, রায়দিঘী, উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালি, বসিরহাট, হাসনাবাদ হুগলির আরামবাগ, খানাকুল, গোঘাট, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর, আমতা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটির কাঁচা বাড়ি কার্যত মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে সুপার সাইক্লোন উমফান। বিদ্যুতের তার ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। উপড়ে গিয়েছে খুঁটি। ফলে আগামী কয়েকদিন বিদ্যুৎহীন থাকতে পারে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। একাধিক জায়গায় উপড়ে গিয়েছে গাছ। বিপর্যস্ত শহর কলকাতাও। মহানগরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক হাজার গাছ পড়ার খবর মিলেছে। আমফান কার্যত সর্বনাশ করে দিয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসেব পেতে তিন-চার দিন লেগে যাবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। আগামী কাল, বৃহস্পতিবার বিকেলে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক ডেকেছেন মমতা। এদিন রাতে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত ১০-১২ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। তবে সঠিক সংখ্যা কত তা পরে জানানো হবে।
এই সময়ে রাজনীতি না করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরো পরিস্থিতিকে দেখার আবেদন জানিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “কেন্দ্রের সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে এটাকে রাজনৈতিক ভাবে না দেখে মানবিকতার সঙ্গে দেখতে।”
গত দু’দিন ধরেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছিল এনডিআরএফ এবং রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দল। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মমতা এদিন বলেন, “এই কাজটা যদি আমরা গুরুত্ব দিয়ে না করতাম না জানি কত মানুষের মৃত্যু হত!” আশ্রয় শিবিরে যে সমস্ত মানুষ রয়েছেন, আগামী তিন-চারদিন সেখানেই থাকার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুনর্বাসনের কাজ কী ভাবে করা হবে তা নিয়েও দুশ্চিন্তা ঝরে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। এদিন মমতা বলেন, “ভাবতেই পারছি না পুনর্বাসনের কাজটা কী ভাবে করব।” বহু বাড়ি, বিঘের পর বিঘে ধানক্ষেত, অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু পুকুর। পর্যাপ্ত জল নেই। যদিও এসবই অন্ধকারে দেখা। সর্বনাশ যে কতটা গভীরে তা বৃহস্পতিবার দিনের আলোই বলবে।