নিজস্ব সংবাদদাতা: শেষবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন হয়ত, ভেবেছিলেন এবার লকডাউন উঠে যাবে, ঝড় থেমে যাবে, আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে সব।আগের মতই পড়াতে বসবেন সকাল দুপুর সন্ধ্যা, ব্যাচের পর ব্যাচ কিন্তু নিরাশ করল সরকার। রবিবার সন্ধ্যার পর ফের ১৪ দিনের লকডাউন ঘোষনার পর সেই যে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন আর দেখা হয়নি কারও সাথে। রবিবার তৃতীয় দফার ৫৪ দিন পের করে সোমবার লকডাউনের ৫৫ দিন আর চতুর্থ দফার প্রথম দিনের সূর্য ওঠার আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলেন ঘাটালের মনসুখা এলাকার কিশোর চকের গৃহশিক্ষক অনুপ মাইতি।
বৃদ্ধ বাবা- মার অন্ধের যষ্টি, একমাত্র সন্তান ৩২ বছরের অনুপের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে বাড়িরই সামনের একটি বাঁশ বাগান থেকে। সোমবার ভোরে এই দেহ দেখতে পেয়েই হাহাকারে, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন দুই বৃদ্ধ দম্পত্তি। আশেপাশের গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকায় জনপ্রিয় গৃহ শিক্ষক হিসাবে পরিচিত ছিল অনুপ স্যার বা অনুপদার। মূলত ইংরেজিই পড়াতেন সংগে আর্টসের ও কিছু বিষয়। একেবারেই হত দরিদ্র পরিবারের অনুপের টিউশনিই ছিল একমাত্র ভরসা। বাবা রামাপদ মাইতি জানিয়েছেন, “আমাদের জায়গা জমি নেই বললেই চলে, ছেলের টিউশানিতেই সংসার চলত। টিউশানির টাকাতেই সবে একটা বাড়ি করা শুরু হয়েছিল, ধারদেনা করেই চলছিল সেই কাজ। প্রায় আড়াই মাস ধরে রোজগার বন্ধ। যাঁরা নির্মাণ সামগ্রী ধারে দিয়েছিলেন তাঁরা ধার মেটানোর জন্য খুব তাগাদা দেননি কিন্ত তবুও একটা চাপ ছিল। ক’দিন ধরেই মনমরা হয়েছিল ছেলেটা। বলেছিলাম, ভাবিসনা সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু কী যে হয়ে গেল!”
মৃতদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি পুলিশ একটি জবানবন্দি বা সুইসাইড নোটও উদ্ধার করেছে। সেই সুইসাইড নোটে কি লেখা আছে তদন্তের স্বার্থে তা নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি পুলিশ। যদিও সূত্র মারফৎ জানা গেছে লকডাউনের ফলে উপার্জন না হওয়া আর বাড়ি বানাতে গিয়ে ধার দেনা হয়ে যাওয়ার কথাই উল্লেখ করে গেছেন ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় অনুপ স্যার। এম.এ পাশ করার পর চাকরি জোটেনি। ক্রমে গৃহ শিক্ষকতাকেই পেশা করে নেন তিনি। সেই পেশায় সফল হয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল বাড়ি শেষ করেই বিয়ে করবেন, গৃহ কাজ থেকে একটু অবসর দেবেন মাকে। কিন্তু সব ইচ্ছা ঝুলে রইল বাঁশগাছের দোলন হয়ে।
গৃহ শিক্ষকতা বন্ধ হয়ে সারা রাজ্যে এরকমই অসহায় হয়ে পড়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। এঁদের অনেককেই সবজি বিক্রি করতে দেখা গেছে কিন্তু অনুপ যে পথের কথা বলে গেলেন তা বড়ই ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গ গৃহ শিক্ষক কল্যান সমিতির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সমিতির সভাপতি অমর ঘোষ জানিয়েছেন, ” আমাদের জেলাতেই সংখ্যাটা ৫০ হাজার যাঁরা শুধু আমাদের সংগঠনের সদস্য। এর বাইরেও অনেকে আছেন। লকডাউন শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন পর আমরা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলাম, আমরা বলেছিলাম সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনেই আমরা পড়াব। আমাদের অনুমতি দিন। উনি বলেছিলেন, মূখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে জানাব। এরপরেও কয়েকদফা রিমাইন্ডার দেওয়া হয়েছে কিন্তু উত্তর আসেনি। এরপর সোমবার যা হয়ে গেল তা ব্যাখ্যার কোনও ভাষা নেই। শুধু এটুকুই বলার এমনই অনুপ মাইতি হয়ে আছি আমরা সমস্ত গৃহ শিক্ষকেরা।”