নিজস্ব সংবাদদাতা: খড়গপুর স্টেশনের দক্ষিনে একদা সাহেব সুবা দের বাংলো সাইড আর রেলের করনিকদের আদি বাস বাবুলাইনের গা ঘেঁষে গমগমে বাজারের নাম বোগদা। লকডাউনের বাজারে সেই খাঁ খাঁ বোগদাতে কখনও পুরী সবজি, কখনও লুচি আলুর দম, কখনও আবার ইডলি ওকমা নিয়ে বসে থাকা ‘সন্তোষ’কে দেখে লকডাউনের বাজারেও কাজে যেতে হচ্ছে এমন মানুষ মুচকি হেসেছে আর মনে মনে বলেছে, ব্যাটা জাত মাড়োয়াড়ি ! সু্যোগ বুঝে পুলিশকে ম্যানেজ করে ঠিক ব্যাবসা ফেঁদে বসেছে!
মানুষের মনে করার মধ্যে অবশ্য খুব একটা দোষের নেই । বোগদার বাজারে পুরী সবজি, ইডলি , ধোশা, বড়া , ওকমা থেকে শুরু করে চপ পাকোড়া মায় ভাত রুটির খান পঁচিশেক দোকান থাকলেও সন্তোষ খালি চা আর বিস্কুটই বেচে আসছে এতদিন। আর সেই সব দোকান এখন বন্ধ। সেই বাজারে যদি সন্তোষ এমন একটা দোকান হঠাৎ করে খুলে বসে মানু্ষকে দোষ দেওয়া যায়না। সন্তোষের আরও সমস্যা তার নামের পেছনে কী করে যেন মাড়োয়াড়ি পদবীটা জুটে গেছে। তাই সব কিছু মিলিয়ে সন্তোষ এই দুর্দিনের সু্যোগ নিয়ে কামানোর ভাল বন্দোবস্ত করে নেবে এতে আশ্চর্যের কী ?
তবে ভুলটা ভেঙে যেতেও সময় লাগেনা বেশিক্ষন। পথ চলতি এক রেলবাবু বাড়ি থেকে খেয়ে বেরুনোর সময় পাননি সেদিন। বাড়ি থেকে টিফিন করে সন্তোষের দোকানে গাঢ় দুধের চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেয়েই অফিসে ঢোকা তাঁর রেওয়াজ। লকডাউনের বাজারে সন্তোষ আবার চা বিক্রি করছেনা, এখন শুধুই নাস্তা। তো বাধ্য হয়েই সেই রেলবাবু চার পিস পুরী সবজি পেটে ফেলে মানি পার্শে হাত দিতেই সন্তোষ বলল, ”পয়সা লাগবেনা।” রেলবাবু অবাক ! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন আর তারপরই আরও অবাক হওয়ার পালা! সকাল ৭ টার পর পিল পিল করে লোক আসতে শুরু করল আর সন্তোষ তাদের তুলে দিতে লাগলেন সেদিন সকালের মেনু পুরী আর সবজি!
জানা গেল লকডাউনে শেষবার যে ট্রেন থেমে গিয়েছিল খড়গপুর জংশনে। তাঁর জনা তিরিশেক মানুষ যাঁদের বাড়ি ভিন প্রদেশে, যাঁদের আবাস এখন খড়গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলো যাওয়ার পথে ফুটপাত, জনা ২০ভিখিরি যাঁদের এখন ভিক্ষে জোটেনা, জনা দশেক ভিখিরি, পথ চলতি মানুষ সব মিলিয়ে শতাধিক মানু্ষের সকালের নাস্তা যোগান দিচ্ছেন সন্তোষ।
সন্তোষ মাড়োয়ারি পোশাকি নাম আসলে সন্তোষ কুমার হালওয়াসিয়া। উড়িষ্যার কটক এর বিমানী গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ আজ থেকে ৩৪ বছর আগে একটা ট্রেনের কামরায় উইথ আউট টিকিটে যাত্রী হয়ে চলে আসেন খড়গপুরে, কাজের খোঁজে। কাজ তেমন জোটেনি তবে প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে পুরী সবজি , চা , কফি ইত্যাদি বিক্রি করতে শুরু করেন কিন্তু বাজার জমাতে পারেননি। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ডিউটি দেওয়া রেল সুরক্ষা বাহিনী বা আরপিএফের কিছু আধিকারিক আর জওয়ান বুঝে যান সহজ সরল সন্তোষ জমাতে পারবেন ব্যাবসা। তাঁরা সন্তোষ কে নিয়ে চলে আসেন আর পি এফ অফিসে, রাতে অফিস দেখভালের জন্য। রাতে সেখানেই থাকা। কিন্তু এভাবে তো আর দিন চলেনা! বাড়ির জন্য পয়সা চাই যে !
বছর বাইশেক আগে আরপিএফ এর
আধিকারিকরাই ফের বোগদাতেই তাকে একটি চায়ের দোকান খুলে দেন। সন্তোষের সেই চায়ের দোকান এখন বিখ্যাত। মোটা দুধের কড়া পাকের সেই সন্তোষের চা খেতে এখন রেলের আধিকারিক, রেল সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ান, সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ কে না আসেন? খড়গপুরে এলেই প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে বিজেপির রাজ্যসভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের চায়ে পে চর্চা এখানেই জমে ওঠে। কিন্তু কেন এই উদ্যোগ প্রশ্ন করতে মিতভাষি সন্তোষ জানায়, ‘একদিন নিঃস্ব অবস্থায় অনাহুত অতিথি হয়ে এসেছিলাম এই খড়গপুরে। ফিরিয়ে দেয়নি খড়গপুর। আজ সেই খড়গপুরের অতিথি হয়ে কেউ না খেয়ে থাকবে এটা চাইনা। দিনে রাতে প্রশাসন পুলিশ আর পি এফ কেউ না কেউ খাবার দিচ্ছেন। আমি তাই সকালটা বেছে নিলাম।’
সন্তোষের এই বিনা পয়সার দোকানে দিব্যি খেয়ে যেতে পারেন লকডাউনে বাধ্য হয়ে বাইরে বের হওয়া মানুষও । সন্তোষের এই অদ্ভুত উদ্যোগ মুগ্ধ করেছে খড়গপুরবাসীকে। তাঁর রসদে যেন টান না পড়ে তাই তাঁর পাশে কয়েকদিন হল এসে দাঁড়িয়েছে খড়গপুরের ইন্দা এলাকার অন্যতম বিখ্যাত দুর্গা পুজার আয়োজক বিদ্যাসাগরপুর পুজো কমিটির ক্লাবের সদস্যরাও।