নিজস্ব সংবাদদাতা: ৮ হাজার মোষ আর গরু! যে পরিমান দুধ উৎপাদন হয় তা দিয়ে দু’বেলা ভাল ভাবে স্নান করে নিতে পারে গ্রামের ৫০০টি পরিবারের ২হাজার থেকে ২২০০ পরিবার। আশেপাশের সাতটি থানা এলাকার মিষ্টি দোকানের ছানা আর দই, খোয়া আর ক্ষীরের যোগান দিত এই গ্রাম। কিন্তু করোনা কেড়ে নিয়েছে সব কিছু। লকডাউনের বাংলায় বন্ধ সব। নিজেদের ভাতের যোগাড় করার পাশাপাশি চিন্তা আয় না হলে এতগুলো অবোধ প্রানীকে খাওয়াবে কী করে! এরই মধ্যেই আশার আলো ক্ষীন হলেও দেখা গিয়েছিল মূখ্যমন্ত্রীর ঘোষনায়। লকডাউনের মধ্যে রাজ্যে ৪ ঘণ্টা করে মিষ্টি দোকান খোলা থাকার কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু দিনের শেষে হতাশ গ্রামের দুধ-ছানা বিক্রেতারা। তারা জানালেন, মিষ্টি ব্যবসায়ীরা দুপুরে এই ৪ ঘন্টা দোকান খুলে রাখার সিদ্ধান্তে ভরসা পাচ্ছেন না। দোকানে কারিগরের অভাব। মিষ্টি তৈরির পর বিক্রি হবে কিনা! কোন ভরসায় মিষ্টি ব্যবসায়ীরা দুধ, ছানার অর্ডার দেবেন! ফলে হতাশ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনির শৌলা গ্রাম।
পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি এই ছোট গ্রামে রয়েছে ৮ হাজার মোষ ও গরু। ৯০টি গোয়ালা পরিবার। কিন্তু প্রায় প্রতিটি পরিবারই কম বেশি গবাদি পশু পোষেন। গ্রামে কয়েক হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। গ্রাম থেকে প্রায় দেড়শ মানুষ দুধ-ছানা-পনির বিক্রি করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর, শালবনি, কেশপুর, খড়্গপুর নাড়াজোল সব বিভিন্ন বাজারে দুধ ও ছানা সরবরাহ হত এই গ্রাম থেকে। এই লকডাউনের ফলে দোকান বাজার না খোলা থাকায় ফেলতে হচ্ছে দুধ। অর্ধেক দামেও দুধ নেওয়ার লোক নেই। অনেকে ছানা-পনির তৈরি করে গ্রামে, শহরে জলের দামে বিক্রি জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাতেও খদ্দের নেই। শালবনির শৌলা গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী গোপাল ঘোষ বলেন, ‘আমার নিজের ৬০টি মোষ ও গরু রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৭০ লিটার দুধ বিক্রি করতাম। বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে ছানা, পনির সরবরাহ করতাম। এখন কুড়ি লিটার দুধও বিক্রি করতে পারছিনা’। গোপাল ঘোষের বড় ছেলে রাজু ঘোষ বলেন, ‘কিছুটা দুধের ছানা, পনির তৈরি করে বিক্রির জন্য মেদিনীপুর, খড়্গপুরে ঘুরছি। ৩৩০ টাকা কেজির পনির ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে না। রাস্তাঘাটে বেরোতেও ভয় হচ্ছে’।
মারন ভাইরাস ‘কোভিড ১৯’ বা ‘করোনা’র জেরে সতর্কতা হিসেবে সারা দেশে চলছে ‘লকডাউন’। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য চালু থাকলেও মিষ্টির দোকান সহ অন্যান্য সম্পূর্ণ বন্ধ। আর এই অবস্থায় চরম সমস্যায় পড়েছেন রাজ্যের দুধ ব্যবসায়ীরা। দুধ ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে মঙ্গলবার থেকে দুপুরে ৪ ঘন্টা করে মিষ্টির দোকান খোলা থাকার কথা ঘোষনা করলেও ভরসা পাচ্ছেন না মিষ্টি বিক্রেতারা।
শুধুই শৌলা নয়, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এরকম আরও অনেক গ্রামে মোট দুধ ও দুধ জাত দ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। সরকারের হিসেব অনুযায়ী জেলায় দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ৪ লক্ষ লিটার। বর্তমানে যার অধিকাংশটা নষ্ট হচ্ছে। শালবনির শৌলা গ্রামে মোষের দুধ বেচা ও পশু পালনে মডেল গ্রাম। মাসে কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করেন ওই গ্রামের মানুষ। গ্রামের বাসিন্দা দীপক সাউ, গৌতম সাউ’রা বলেন, আমাদের প্রত্যেকের গড়ে ৫০-৬০টা করে মোষ আছে। প্রতিদিন প্রায় একশো লিটার দুধ বিক্রি করতাম। এখন ত্রিশ লিটার বিক্রি করতে পারিনি। দীপক বলেন, গ্রামের কিছু গরীব মানুষ নিতে চাইলে দিয়ে দিচ্ছি। নাহলে ফেলে দিচ্ছি, বাছুরে খাচ্ছে। কী আর করার আছে?’ মালিকদের ভাষাও বোধহয় বোঝে অবুঝ পশুর দল। সাংবাদিকদের দেখে চোখে তাদের আশার আলো। ভাবে নতুন খদ্দের, বাজার আবার খুলল বলে।