নিজস্ব সংবাদদাতা: রবিবার সাত সকালে প্রণতির বাবা শ্রীমন্ত নায়েক আর প্রতিমা নায়েক টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসার আগেই টিভির সামনে বসেছিলেন প্রণতি নায়েকের প্রাক্তন কোচ মিনারা বেগম। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার এক অজগাঁ থেকে উঠে আসা প্ৰণতিকে যিনি আজকের প্ৰণতি বলে নির্মাণ করেছেন, ঠিক যেমনটা একজন ভাস্কর পাথর কুঁদে কুঁদে মূর্তি নির্মাণ করে। টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে মিনারা শুধু কেঁদেছেন আর ভেবেছেন একটি সুন্দর প্রতিভাকে এত অবলীলায় ধ্বংস করল কে? ততক্ষণে সারা ভারতে বাংলার জিমন্যাস্ট প্ৰণতির অলিম্পিক থেকে ছিটকে পড়ার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। টিভির সামনে নিজের দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছেন মিনারা বেগম। তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। তাঁর হাতেই ১৮বছর ধরে তিলে তিলে গড়া বাংলার তিলোত্তমার বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে!
বাংলার একটি সংবাদমাধ্যমকে নিজের হতাশা উজাড় করে দিয়ে মিনারা বলেছেন,” প্রথম থেকেই কোথাও একটা গন্ডগোল ছিল। অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য যে যোগ্যতা অর্জনের দরকার ছিল সেভাবেই আমিই প্ৰণতিকে তৈরি করেছিলাম অথচ অনুশীলনে আমাকে ঢুকতেই দেওয়া হলনা? তাও আমি হয়তো হাজিরও হতাম ওদের অনুশীলনে। কিন্তু অতিমারী পরিস্থিতিতে গ্রিন জোন তৈরি করে আলাদা করে ট্রেনিং করানো হয়েছে। ফলে আমার ওখানে ঢোকার কোনও জায়গাই ছিলনা” সবকিছুর মধ্যেই চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছেন মিনারা। জিমন্যাস্টিক্সের সার্কিট থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে দাবি অভিজ্ঞ কোচের। মিনারা বলছেন, “ওদের তো আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। আমি একজন অলিম্পিয়ান তৈরি করেছি। আমাকে জিমন্যাস্টিকস থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সেই কারণেই অলিম্পিকে যেতে দেওয়া হল না আমাকে।”
পিংলার গ্রাম থেকে প্ৰণতি কলকাতায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন তখন নিজের বাড়িতে রেখে দিনের পর দিন অনুশীলন করিয়েছেন মনিরা। শুধু অনুশীলনই নয় প্ৰণতিকে মা-বাবার কষ্ট অনুভব করতে দেননি মনিরা। অথচ সেই মনিরাকেই জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন টোকিওয় যেতে দেওয়া হয়নি। কেন? কোথাও কী কোনও খেলা কাজ করেছে? কতগুলো প্রশ্ন তুলেছেন প্ৰণতির কোচ। বলেছেন, “ব্যাকে আজকে ৩৬০ করেছে। ফ্রন্টেও তো ৩৬০ করার কথা ছিল। সেটাই তো করল না। তার মানে ও প্র্যাকটিস করেনি। আমার ট্রেনিংয়ে ৭২০ করেছে। ভল্ট টেবিলে কোয়ালিফায়েড হতে গেলে দুটো ভল্ট করতেই হয়। না হলে কোয়ালিফাই করার কোনও জায়গাই নেই। আমার কথা খুব সহজ। তুমি সাফল্য পাও আর চাই না পাও, যেটা জানো সেটা ঠিকঠাক করে এসো। যে প্র্যাকটিস করা উচিত ছিল, কোচের অনভিজ্ঞতার জন্য সেটাই হল না। এতটা খারাপ পারফরম্যান্স করবে আমি আশা করিনি।”
প্রণতির পারফরম্যান্স দেখে ক্ষুব্ধ প্রাক্তন কোচের একগুচ্ছ প্রশ্ন, “কেন একটা ভল্ট করল? দুটো ভল্ট না করলে পদক জেতা যায় না, পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করা যায় না। ও তো সব জায়গাতেই দুটো ভল্টই করে। এখানে কেন করল না? আমার কাছে আগে থেকেই খবর ছিল অলিম্পিকে ও দুটো ভল্ট দেবে না।” বাংলার জিমন্যাস্টের দায়সারা পারফরম্যান্স দেখে কেঁদে ফেলে মিনারা বলেন, “বিশ্রী পারফরম্যান্স করেছে। বিমে হতাশ করেছে। আনইভেন বারে পা ঠেকে গেল নীচে। তা হলে কী ট্রেনিং করল এতদিন?” এরপরই মিনারার আক্রমণের মুখে বর্তমান জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন এবং প্রণতির কোচ লক্ষ্মণ শর্মার উদ্দেশ্যে বলেছেন, “টাইম পাস করেছে। প্র্যাকটিসটাই তো করেনি। কোচকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। প্লেয়ার অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে প্লেয়ারের কথা শুনে চললে এরকমই হবে। জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন বা উপর মহলের মানসিকতা যদি এমন হয়, তা হলে ব্যর্থতাই সঙ্গী হবে। এত বড় ভুল হল কী করে?
টোকিও পৌঁছানোর পর একের পর এক ছবি পোষ্ট করতে দেখা গেছে প্ৰণতিকে। কোথাও কোচের সঙ্গেও। যেন বেড়াতে গেছেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নয়।
মিনারা বলছেন, “এত ছবি পোস্ট করার কারণ কী? রিও অলিম্পিকে যাওয়ার পর থেকে দীপা কি এত ছবি পোস্ট করেছিল? বিশ্বেশ্বর নন্দী ওর সঙ্গে গিয়েছিল। ছাত্রীর যাতে ফোকাস না নড়ে, সেই চেষ্টাই করে গিয়েছিলেন দীপার কোচ।”
দুঃখে যন্ত্রনায় ভেঙে পড়ে মিনারা বেগম বলছেন, “একজন জুনিয়র কোচ তো আর প্লেয়ার তৈরি করে না। তাই বুঝবে না আমার বুকে কতটা লাগছে। আমি তৈরি করলাম, আর এভাবে আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমি টিভির সামনে বসে কেঁদেছি। এটা এশিয়ান বা কমনওয়েথ গেমস নয়। অলিম্পিককে হালকা হিসেবে নিল। আমি গেলে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হতো ওকে। আমার কোচিংয়েও অনেক জায়গায় গিয়েছে প্রণতি। আমাদের আগেই বলেই দেওয়া হত, দেশে ফিরলে তবেই ছবি পোস্ট করবে। আমার তো সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ফোটোসেশনই হয়েছে। আর কিছু হয়নি।”