সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান! রবীন্দ্রনাথকে দেখা শেষ মেদিনীপুরবাসী :কামরুজ্জামান
নিজের রবীন্দ্র দর্শন সম্পর্কে আজহারুদ্দিন খান বলেছেন, ‘ এই স্কুলের কল্যাণেই আমি ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখি- রবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়। …আমাদের প্রধানশিক্ষক বিদ্যালযয়ের সমস্ত ছাত্রকে স্কুলের সামনের রাস্তার দু’ধারে লাইন করে শীতকালের সকালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরনে ছিল হাত কাটা গেঞ্জি কালো প্যান্ট। রবীন্দ্রনাথ বেলা ৯টায় আমাদের বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হুড খোলা মোটরে আস্তে আস্তে চলে গেলেন স্মৃতি মন্দির উদ্বোধন করতে। তিনি চলে গেলে আমরা কলেজ মাঠে ডিঙিয়ে তাঁর পৌঁছাবার আগে স্মৃতি মন্দিরে গিয়ে পৌছালাম। বিকেলের দিকে কবিগুরুকে সমবেত ভাবে ড্রিল দেখানো হয়েছিল। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য এই বিদ্যালয়ে পড়তাম বলেই সম্ভব হয়েছিল। বিদ্যালয়ের কাছে এটি আমার প্রধান ঋণ।” উল্লেখ্য দিনটি ছিল আপামর মেদিনীপুরবাসীর কাছেই গৌরবের। সেই দিনটি ১৯৩৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। সেদিন বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বার উদঘাটন করতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে অনুভূতি সম্পর্কে আজহারুদ্দীন খান বলছেন ‘রবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়’।
এই রবীন্দ্র দর্শন কিশোর আজহারউদ্দীন খানের মনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল আর এখান থেকেই তাঁর অন্তরে সাহিত্য প্রীতির বীজটি রোপিত হয়েছিল কী না, তা তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যত গবেষকরা বলবেন কিন্তু ঘটনা হল তাঁর প্রথম প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই। মুদ্রিত আকারে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় হাজার ১৯৫০ সালের ২৯শে জানুয়ারি রবিবারের যুগান্তর ‘সাময়িকী’তে ‘কবি দর্শনে’! যদিও তিনি প্রথম লেখাটি লেখেন ‘মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ’। মেদিনীপুরের কলেজ পত্রিকাটি ১৯৪৯ সালের পরিবর্তে প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৫০ সালে। তাই মুদ্রিত হিসেবে ‘কবি দর্শনে’ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত রচনার মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫১ সালের যুগান্তর সাময়িকীর রবিবারে ‘কায়কোবাদ’ এবং এস.ওয়াজেদ আলিকে নিয়ে দুটি লেখা প্রকাশিত হয়। আজ ২২শে জুন, মঙ্গলবার, ২০২১, আমরা হারালাম মেদিনীপুরের সেই শেষ ব্যক্তিকে যিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন। তিনি আজহারুউদ্দীন খান,
দুই বাংলায় সাহিত্যচর্চায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম। যার সৃষ্ট প্রবন্ধ বাংলা তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের মহাসম্পদ।
আজহারউদ্দিন খানের জন্ম যার ১৯৩০সালের ১ জানুয়ারি, মাতামহ দাদ আলি খানের মেদিনীপুরের মীরবাজারের বাড়িতে। মা কামরুননেশা। বাবা নসেরুল্লাহ খান উড়িষ্যার কটকের বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে থাকতেন খড়গপুরে। মামার বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছেন। তাঁর হাতে খড়ি হয় মাতামহীর কাছে। বর্নপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, বোধদয় পড়েছেন তার কাছে। মাতামহী তাঁকে খুব যত্ন নিয়ে উর্দু ফয়জা শিখিয়েছিলেন। অতঃপর পাঁচ বছর বয়সে প্রাণকৃষ্ণ রানার পাঠশালায় ভর্তি হন। মাসিক বেতন দু’আনা। মাতামহী আগ্রহে ১৯৩৮ সালে কলেজিয়েট স্কুলে সর্বনিম্ন ক্লাস তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন।
মাতামহীর আগ্রহে কানাই ভৌমিক নামের একজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তেন। কানাই ভৌমিক পরবর্তীকালে জেলার অন্যতম কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক দপ্তরের মন্ত্রী। কানায় ভৌমিক এর প্রভাব তার চরিত্রে স্থায়ীভাবে ছাপ ফেলে যায়। কানাই ভৌমিক চলে যাবার সময় বাম মানসিকতার একজন বন্ধুকে তার গৃহ শিক্ষক হিসাবে যুক্ত করে যান। এভাবেই কৈশোর থেকে তিনি কমিউনিষ্টব মনোভাবপন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে জুলাই মাসে আজহারউদ্দিন খান মেদিনীপুর কলেজের আই.এ তে ভর্তি হলেন। আই.এ পাশ করে ১৯৪৮ সালে বি.এ ক্লাসের ভর্তি হলেন ১৯৪৭ সাল থেকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বিষয়ের পড়াশুনো, পত্রিকা প্রকাশ, নজরুল সম্পর্কে তথ্য তালাশ করতে গিয়ে পরীক্ষার পড়া হয়ে ওঠেনি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। বি.এ পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি। দু-একটা পেপার পরীক্ষা দেওয়ার পর আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বি.এ পাশ না করেই কলেজ ছাড়েন। এই সময় থেকেই শুরু হয় তার সাহিত্য প্রীতি। সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বে তার প্রধান নেশা ছিল বইপড়া।
স্পেশাল ক্যাডার শিক্ষক হিসাবে আজহারউদ্দীন খান ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে আঁধারনয়ন জুনিয়র হাই স্কুলে যোগদান মাসিক ৮০ টাকা বেতনে। এই কাজ তাঁর পছন্দ ছিল না। শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা, নিজের পড়াশুনার কোন সুযোগ না পাওয়াই ছিল এর প্রধান কারণ। সে সময় আঁধারনয়নে কোনো ডাকঘর ছিলনা। এই সময়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ প্রকাশের কাজ চলছে কলকাতায়। ৮টি প্রবন্ধ নিয়ে ডিমাইর সাইজের ২১২ পৃষ্ঠার বই মে মাসে প্রকাশিত হল। এখানে থেকে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। সুযোগ খুঁজছিলেন মেদিনীপুরে চলে আসার।
অচিরে মনের মতো কাজের সুযোগ এলো। বিজ্ঞাপন পড়ে জানতে পারলেন মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে কর্মী নেওয়া হবে। আবেদন করলেন কর্মপ্রার্থী হিসাবে। মনোনীত হয়ে ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে মাসিক ৭৫টাকা বেতনে কাজে যোগ দিলেন। কাজের সঙ্গে প্রচুর বই পড়ার অফুরন্ত সুযোগ। জ্ঞানের দরজা হল অবাধ, উন্মুক্ত। জেলা গ্রন্থাগারে কাজ করতে এসে ১৯৭২ সালে বি.এ এবং ১৯৭৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.লিব.এল.বি পাশ করলেন। অবশ্য ১৯৫৯ সালে বেঙ্গল লাইব্রেরী এ্যসোসিয়েশন থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে সার্টিফিকেট কোর্স করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি লিখেছেন। দীর্ঘ ৬০ বছর সময়কালে তিনি দেড়শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন। রচনা করেছেন ১৭টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ গ্রন্থ। ১৫ টি গ্রন্থ এবং তিনটি পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। লিখেছেন তেত্রিশটি গ্রন্থের ভূমিকা। ১০ জন লেখক তাঁদের ১০টি গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন ।
সাহিত্যিক আজহারুদ্দীন খানের লেখার বৈশিষ্ট্য প্রধানত সাহিত্যচর্চার যে সমস্ত দিক অনালোচিত বা যে সব প্রতিভাবান সারস্বত ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ আলোচনা গ্রন্থ রচনায় কেউ উৎসাহ বোধ করেননি সেসব বিষয়ে তিনি গবেষণামূলক বই লিখেছেন।বাংলা সাহিত্যে নজরুল, বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যে মোঃ আব্দুল হাই, গ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য ইত্যাদি। ‘বিলুপ্ত হৃদয়'(মীর মোশারফ হোসেন, মোজাম্মেল হক প্রমুখ জীবনী), ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (মুনীর চৌধুরী), ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ ( আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ), ‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির’ (শাহাদৎ হোসেন ), ‘মেধাবী নীলিমা'(মুহম্মদ শহীদুল্লাহ), ‘দীপ্ত আলোর বন্যা'(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী)। লিখেছেন সাহিত্য সাধনায় বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়।
দু’পার বাংলায় নানাবিধ সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। নজরুল পুরস্কার (১৯৮২), মুহম্মদ আবদুল হাই পুরস্কার (১৯৮৩) বাংলাদেশ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৯৯৭), নজরুল পুরস্কার (২০০৩)পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০৭ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট উপাধিতে সম্মানিত। ১৯৮৩ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। ১৯৮৯-২০০৪ ওই সংগঠনের রাজ্য কমিটির সহসভাপতি। মৃত্যুকালে রেখে গেলেন স্ত্রী হাসনাবানু ও দুই পুত্র আরিফ (দীপন) ও আসিফ (সুমন)কে। বাংলা ‘প্রবন্ধ’ সাহিত্যে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হল।