নারীমুক্তিবাদী
জ্যোতির্ময়ী দেবী বিনোদ মন্ডল
উনিশ শতকের নবজাগরণে যে কয়েকজন কৃতী নারী আপন প্রয়াসে আধুনিকতার পথ খনন করে অগ্রসরমান হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম – লেখিকা জ্যোতির্ময়ী দেবী (২৩. ০১. ১৮৯৪ — ১৭ .১১. ১৯৮৮)। ৯৪ বছরের জীবন তাঁর। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত বহু সাহিত্যিকের চারণপীঠে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর স্বতন্ত্র এবং ঋজু উচ্চারণের জন্য স্মরণীয় থাকবেন। স্মরণীয় থাকবেন বাংলা উপন্যাসের ভৌগোলিক পরিধি বিস্তার দানের জন্যে ; নারীদের চোখ দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজের সনাতন রূপটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যে ।
বাবা অবিনাশ চন্দ্র সেন। মা সরলা দেবী। জন্মগ্রহণ করেন রাজপুতানার জয়পুর শহরে। তাঁর ঠাকুরদা সংসার চন্দ্র সেন ছিলেন জয়পুরের মহারাজের দেওয়ান। মাত্র ১০ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় হুগলির গুপ্তি পাড়ায় (১৯০৪)। স্বামী কিরণ চন্দ্র সেন ছিলেন পাটনা কোর্টের উকিল। ১৯১৮ সালে (শতবর্ষ আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাস খ্যাত মহামারীতে) ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু হয় তাঁর। ২৫ বছর বয়সে সদ্য বিধবা যুবতী জ্যোতির্ময়ী ছ’ ছ টা ছেলে মেয়ে কোলে – পিঠে নিয়ে ফিরে আসেন জয়পুরে। পিত্রালয়ে। অকালবৈধব্যের নিঃসঙ্গতায় শুরু হয় আত্মসমীক্ষা – এ জীবন লইয়া কী করিব? নিবিড় পাঠাভ্যাস, কবিতা রচনা এবং সমকালীন রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ঢেউ ভাঙার খেলায় মেতে ওঠেন তিনি।
লেখনি ছিল তাঁর আত্মপ্রকাশের হাতিয়ার। বাঁচবার জন্য সঞ্জীবনী শস্ত্র। দেশের পরাধীনতা এবং মেয়েদের পরাধীনতাকে নিরবচ্ছিন্ন চেহারায় যাচাই করেছেন তিনি। তাঁর জীবনসংগ্রাম প্রসূত নারীবাদী চেতনাই তাঁর সৃষ্টি ও সংগ্রামের মূল উপাদান। পুরুষসমাজ মেয়েদের লেখালেখিকে কখনো উপযুক্ত সম্মান দেয়নি। ফলে লেখার মধ্যে দিয়েই জ্যোতির্ময়ী দেবী আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে গেছেন।
সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিকটি উল্লেখ করতে হবে। কেননা তাঁর মতাদর্শ যা সাহিত্যে প্রকীর্ণ, তাকে পুষ্ট করেছে এই রাজনৈতিক সত্তা। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী। সর্বভারতীয় মহিলা সংঘের (AIWC) সহ-সভানেত্রী। ফলে শুধু মধ্যবিত্ত মহিলারা নন, সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া মহিলাদের নানাভাবে স্বনির্ভর করবার চেষ্টা ছিল তাঁর। হিন্দু সমাজের নানা দলিত নারী, বারাণসীর হিন্দু বিধবা, পতিতালয়ের রমণী , রাজস্থানের নির্যাতিত নারী, হরিজন সম্প্রদায়, ভাঙ্গি সমাজ, দেশভাগের যন্ত্রণা, মানব সম্পদের অপচয় — তিনি দেখেছেন মেয়েদের চোখে। সমকালীন নানা রাজনৈতিক প্রসঙ্গে তাঁর চরিত্ররা আন্দোলিত হয়েছে বারংবার।
প্রথমে সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে কবিতা প্রকাশ করতেন তিনি। পরে কথাসাহিত্যে স্বনামে বিচরণ শুরু করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাহিত্য জগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা ছিল বন্ধুপ্রতিম কান্তি চন্দ্র ঘোষের। প্রাথমিকভাবে তিনি পত্রপত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করান। ১৩২৮ সালের আষাঢ় মাসে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা – ‘নারীর কথা’। ভাবতে অবাক লাগে এখনো অনেকে ভাবেন, ভারতবর্ষে নারীবাদী আন্দোলন পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ! তাহলে একবার লেখাটির সামান্য অংশে নজর দেওয়া যাক: “মহিলা শিক্ষার কথা উঠলেই পুরুষেরা ভয় পেয়ে যান – পাছে ঐ উৎপীড়িতারা উৎপীড়ন বুঝতে পারেন, পেরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, যথেচ্ছাচার সহ্য না করেন। তাই কত রকম করে বলা হয় ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমরা পবিত্র ভারতবর্ষের পুরনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। সৌভাগ্যক্রমে মহিলারা এখনো পাশ্চাত্য শিক্ষা পাননি; তাই সনাতন হিন্দু ধর্মের কঙ্কালটা আছে (কঙ্কালই বটে)। অতএব তোমরা শুদ্ধান্তঃপুরে স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় দিও না।” বড় অসহায় ভাবে নাপার মহিলা, বিধবার সব আচারকে ছয় দশক ধরে মেনে চলেছিলেন কিন্তু মনন জগতে শুদ্ধান্ত:পুরকে কখনো রেয়াত করতে পারেননি।
তাঁর ‘চক্রবাল’ কবিতা সংকলন এর ভূমিকা রচনা করেন উমানাথ ভট্টাচার্য। ভূমিকায় আছে “কবিতা গুলি পড়ে মনে হয় কবিযশ প্রার্থিনী হয়ে এগুলি রচিত হয়নি। এ লেখা তো মনের বাহন, না লিখে মুক্তি নেই।” ‘স্ফিংকস্’ কবিতায় তিনি ইতিহাসের বর্বর রাজাদের সমাজে পিতৃতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন –
আমরা জানি আমরা মিছে কথা বলি।
কারণ, তোমরা সত্যি সইতে পারো না।
তাই আমরা বলি, তোমরা মহৎ, তোমরা উদার। তোমরা বীর।
আর তোমরা বিশ্বাস করো। (করো কি?)
জ্যোতির্ময়ী দেবীর প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকার দিকে তাকানো যাক। ১) ছায়াপথ (উপন্যাস), রাজযোটক (ছোটগল্প), বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ (উপন্যাস), মনের অগোচরে (উপন্যাস), আরাবল্লীর আড়ালে (ছোটগল্প), ব্যান্ড মাস্টারের মা (ঐ), আরাবল্লীর কাহিনী (ঐ), সময় ও সুকৃতি (ভ্রমণ), এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা (উপন্যাস), পঞ্চনদীর তীরে (বয়স্ক শিক্ষা), সোনা রূপা নয় (গল্প), রাজারানীর যুগ, জ্যোতির্ময়ী দেবীর রচনাবলী, চক্রবাল, হরিজন উন্নয়ন কথা, স্মৃতি-বিস্মৃতির তরঙ্গ, মর্ত্যের অপ্সরা, এবং চিরন্তন নারী জিজ্ঞাসা : সেকালিনীর স্মৃতি। তালিকাটি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একাডেমি পত্রিকা (৩) থেকে সংগৃহীত।
রবীন্দ্র কবিতায় নারী চরিত্র প্রতিলিপি খুঁজে পেয়েছেন যশোধরা বাগচী। তার মানে জ্যোতির্ময়ী দেবী নির্মিত চরিত্রগুলির কথা বলা হচ্ছে। তাঁর উপন্যাসের নর-নারীর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি কবির অনুপম পংক্তিগুলি স্মরণ করেছেন:
“সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার
থাকিয়া থাকিয়া…..
তারি সেই যাওয়া সেই চেনার আলোক দিয়ে
আমি চিনি আপনারে।”
জ্যোতির্ময়ী নিজের জীবনে বাল্যবিবাহের কারণে যে স্ত্রী শিক্ষার অভাব অনুভব করেছেন, সেই স্বপ্ন গুলিকে সফল করতে বেছে নিয়েছেন সৃষ্ট স্ত্রী চরিত্র গুলিকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ছায়াপথ’ এর নায়িকা সুপ্রিয়া সেই নবজীবনের চেতনায় উদ্ভাসিকা। পিতার অকাল মৃত্যুতে সুপ্রিয়ার পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে। তার পূর্ব প্রণয়ী অজিত তখন তাকে ছেড়ে বাবা-মার বাধ্য ছেলেটি হয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। এবার সুপ্রিয়ার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। সে বিদ্রোহী হয়। বিরক্তি ও গ্লানিতে ভরে ওঠে তার মন:
আমাকে আর তোমরা সাজিয়ে গুজিয়ে কনে দেখিয়ে কিংবা বড়লোক, গহনাগাঁটির লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশ ভরা এরকম সৎপাত্র দেখিয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। আমিই যদি কোনদিন বিয়ে করি, এরকম সৎপাত্রকে করবো না, পুরুষ মানুষকে করব। মনিকা হাসলে, ‘মানে ওরা কি সব মেয়ে মানুষ?’ সুপ্রিয়াও হাসলে, ‘না তারও চেয়ে বেশি, ওরা ছেলেমানুষ।’
‘বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ’ উপন্যাসের নায়ক নীতীশের মনে ব্যক্তিগত বঞ্চনা আর রাষ্ট্রিক বঞ্চনার মধ্যে সমান দরদের ঠাঁই করে নেয় – নারীর অবমাননাও। তাই গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানে শামিল হওয়া কালো মেয়ে বীণা নীতিশের ‘নিরঙ্কুশ’ এবং ‘মুক্ত’ সঙ্গী হয়ে ওঠে। জীবনের অনেকটা সময় দুটি পর্যায়ে রাজস্থানে কাটিয়েছেন তিনি। স্বভাবতই তাঁর লেখায় বাংলাদেশের পাশাপাশি রাজপুতানার সমাজ, আচার-অনুষ্ঠান, সমস্ত সংসারে ভরা জীবনের জলছবি ফুটে উঠেছে। ‘বেটি কি বাপ’ ছোটগল্পের পরিণতি কি মর্মান্তিক!
পর পর পাঁচটি নাতনি হওয়ায় অসন্তুষ্ট ঠাকুমা নিজের ছেলের অসুস্থ শিশুকন্যা পদ্মিনীকে আফিম খাইয়ে মেরে ফেলে। ‘লালজী সাহেব’ গল্পটি কাহিনীর অভিনবত্বে অসাধারণ। রাজবাড়ীর দাসী বাঁদি রক্ষিতাদের গর্ভজাত পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের বলা হতো ‘লালজী’। বাকিটা উহ্য রাখা হল – প্রিয় পাঠক, পড়ে নিতে হবে মূল গল্পটি। আর একটি অপূর্ব গল্প ‘পিঁজরাপোল’। কাশীর বাঙালি বিধবা রমণীদের কথা। ‘মর্ত্যের অপ্সরা’ গল্পের শুরু ‘চাঁপাদাসী’র মৃত্যু দিয়ে।কিন্তু তার শবদেহ কেউ কাঁধে তুলবে না। যে পুরুষের যৌনপিপাসা সে মিটিয়েছে এতদিন, তাদের কাছে তার আজ অস্পৃশ্য – কেন না সে যে ছিল বেশ্যা!
মহীয়সী লেখিকাকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক প্রদান করে সম্মানিত করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর ‘সোনা রূপা নয়’ গল্পগ্রন্থের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে হরনাথ ঘোষ স্মৃতি পদকে সংবর্ধিত করেছে। তাঁর রাজপুতানার গল্পগুলি রাজশেখর বসুর শ্রদ্ধা ও সমীহ অর্জন করেছে। তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁর লেখার অকপট ভক্ত।
তাঁর লেখালেখি নিয়ে আজ আর নিত্য – সমারোহ, সভা সমাবেশ বা সেমিনার চোখে পড়ে না। তাঁর রচনার পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁকে চিত্ত ভরে স্মরণ করা দরকার। চিত্র পরিচালক রাজা সেন তাঁকে নিয়ে যে তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন, তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমান অপরিসীম।