সংবাদদাতা: গুগুল ম্যাপ বলছে মায়াচর থেকে এসএসকেএম (SSKM) ৭৭কিলোমিটার কিন্তু হিসাব বলছে আরও একটু বেশি, অন্ততঃ ৮০কিলোমিটার। এক গুরুতর আহত ব্যক্তিকে রক্ত দিতে এই পথটাই বাইকে করে এসেছেন আক্তারুল আর নিখিলেশরা। রক্ত না পেলে অপারেশন আটকে যাবে যে!
পূর্ব মেদিনীপুরের মায়াচর। রূপনারায়নের গর্ভে বেড়ে ওঠা এই মায়াচর নিয়ে খবর হয়না খুব একটা। খবর হয় নৌকা ডুবে নদীতে মায়াচরের মানুষের লাশ ভাসলে কিংবা প্রবল জলস্ফীতিতে মায়াচর ভেসে গেলে। যেমনটা হয়েছে ২৬মে। ঘূর্ণিঝড় যশ এবারও ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছে মায়াচর। যে সে ভাসানো নয়, নদীর জলস্ফীতি এতটাই ছিল যে ঘরের স্টিলের খাট ঝুলছে গাছের ডালে। হ্যাঁ, এমনটাই ছিল নদীর বুকে ফুলে ওঠার জলের উচ্চতা। নয়াচর আইনগত ভাবে পূর্বমেদিনীপুর জেলার এবং মহিষাদল থানার অন্তর্গত হলেও তার সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানা এলাকার মধ্যে দিয়ে। মায়াচরের নাগরিকদের তাই নিজের থানা কিংবা জেলাসদরে পৌঁছাতে হয় জলপথে যেতে হয় নতুবা স্থলপথে বাগনান, কোলাঘাট হয়ে তমলুক অথবা মহিষাদল।
রবিবার সেই মায়াচরের ত্রাণকার্য আর পর্রিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। আর সেই খবর কভার করতে গিয়েছিলেন আক্তারুল খান ও বন্ধু নিখিলেশ রায়। আক্তারুল একজন সাংবাদিক। সেই জন্যই খবর সংগ্রহে গেছিলেন আক্তারুলরা। সাংবাদিকতা আক্তারুলের একটা শখ বটে কিন্তু আক্তারুল আর নিখিলেশদের নেশা মানুষের বিপদে দাঁড়ানো।
শনিবারও এঁরা এসেছিলেন এই মায়াচরেই, নিজেদের একটি সংস্থার হয়ে, বিধ্বস্ত মানুষের হয়ে ত্রাণ নিয়ে। রবিবার এই খবর সংগ্রহের সময়ই আখতারুলদের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে তাঁর এক বন্ধু জানান SSKM হাসপাতালে এখুনি পৌঁছাতে হবে কারন সোমবার এক আহত ব্যক্তির অপারেশন হবে। যে কারনে চার বোতল রক্তের প্রয়োজন। তাঁর এক বোতল আক্তারুলকেই দিতে হবে। আক্তারুল আর নিখিলেশ মায়াচর থেকে বাইক নিয়ে ছুটলেন সেই রক্ত দিতে।
গত ২৫শে মে জেলা সদর তমলুক থেকে হলদিয়ায় ফেরার পথে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে বাইক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন সাংবাদিক চঞ্চল প্রধান। দুদিনের যমে আর ডাক্তারে টানাটানিতে শেষ অবধি জয় হয় ডাক্তারদের। প্রাণে বেঁচে গেছেন চঞ্চল কিন্তু তাঁর বাঁ হাত কার্যত গুঁড়ো হয়ে গেছে। এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন চঞ্চলের অপারেশন আটকে গিয়েছিল রক্তের অভাবে। চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরেও রক্ত মিলছিল না। পরিবার সহযোগিতা চায় ব্লাড ডোনার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের।
ব্লাড ডোনার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ মারফৎ খবর পেয়েই পূর্ব মেদিনীপুরের মায়াচরে খবরের কাজে ব্যস্ত আক্তারুল বাইক নিয়ে সঙ্গী নিখিলেশকে সঙ্গে নিয়ে রক্তদান করতে ছুটলেন কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে। প্রায় ৩ঘন্টা ধরে ৮০ কিলোমিটার পথ বাইক চালিয়ে আক্তারুলরা যখন এস এস কে এমে পৌঁছান তখন সন্ধ্যা। ব্লাড ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয় রক্ত নেওয়া যাবে না বলে। তারপর অনেক অনুরোধের পর ব্লাড ব্যাঙ্ক আক্তারুলের রক্ত নিতে বাধ্য হয়। সুসংবাদ এনে দিয়েছে আক্তারুল, সোমবারই অপারেশন হবে চঞ্চলের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন চঞ্চলের পরিবার ও বন্ধুরা।
এই হল আক্তারুল খান, নিখিলেশ রায় ও তাঁদের সংগঠন ব্লাড ডোনার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ। এভাবেই মানুষের জন্য, হ্যাঁ শুধুই মানুষের জন্য লড়ে যান আক্তারুলরা। মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এই ব্রততে অটল এই আক্তারুল, নিখিলেশদের মুসলিম আর হিন্দু বলে দেগে দিয়ে ঘৃণ্য জাতি বিদ্বেষের চাষ করতে যারা তৎপর তাদের মুখে কার্যত এভাবেই ঝামা ঘষে দিয়ে কাজ করে যায় আক্তারুলরা।
একদিকে খবরের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম। তার ওপর মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার পন। জীবনকে জীবন্ত রাখার লড়াইতে প্রতিদিন ছুটে চলেছে আক্তারুল। আমতার কুরিটে বাড়ি আক্তারুল খানের। রবিবার সকালে সেই কুরিট থেকে ৫০ কিলোমিটার বাইকে মায়াচর আবার দুপুরে মায়াচর থেকে ৮০ কিলোমিটার পেরিয়ে এসএসকেএম! জীবনের জন্য জীবন যখন এভাবেই ছুটে চলে তখন মৃত্যুই দুরে সরে যেতে বাধ্য হয় তো ধর্মের ষাঁড়রা কী-ই করতে পারে? দ্য খড়গপুর পোষ্টের তরফে কুর্নিশ আক্তারুল, নিখিলেশদের।