নিজস্ব সংবাদদাতা: ঝগড়া করতে জানতেন না এমন মানুষ বোধহয় আর একজনও রইলেননা খড়গপুর শহরে
দুঃখ পেলে যিনি নীরবে দুরে সরে যেতেন যে মানুষটি, তিনি কী কোনও গভীর দুঃখ পেয়েই চলে গেলেন অচিনপুরে ? প্রশ্নটা ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা খড়গপুরে, বিশেষ করে তাঁকে যাঁরা জানতেন। প্রশ্নটা হল, প্রায় ভালো হয়েই উঠেছিলেন যখন, তখন চলে গেলেন কেন? বুধবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ হাহাকার নিয়েই খবরটা ছড়িয়ে পড়ল খড়গপুর শহরে, শুভাশিস দা, শুভাশিস চক্রবর্তী আর নেই! আপাদমস্তক সংস্কৃতিবান, বাংলা সঙ্গীতের অশেষ আধার, অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর গুরু শুভাশিস চক্রবর্তী প্রয়াত হয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের বড়মা হাসপাতালে।
খড়গপুরের আরেক সঙ্গীত গুরু সৌমেন চক্রবর্তী জানালেন, ” আর নেওয়া যাচ্ছেনা, আর কত প্রিয়জনের মৃত্যু গুনতে হবে জানিনা। শুভাশিসদা কিছুদিন আগেই ব্যাঙ্গালুরু থেকে ফিরেছিলেন। ওখানে কর্মসূত্রে ওনার ছেলে থাকে। খড়গপুরে ফিরেই কোভিড আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কয়েকদিন আগেই তাঁকে বড়মা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার সঙ্গে ওনাদের পারিবারিক সম্পর্ক। শুভাশিসদার দাদা আসতেন আমার বাবার কাছে সেই সত্তরের দশক থেকেই সম্পর্ক। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল। উনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিনিয়ত কথা হত ওনার ছেলের সাথে। ভালই চিকিৎসা হচ্ছিল, ভাল হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশ কিন্তু তারপরই হঠাৎ এই দুঃসংবাদ। অসম্ভব ভালো গাইতেন, অনেক ছাত্রছাত্রী কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীত শিক্ষক আমাদেরও নানা সুপরামর্শ দিতেন। আমরা একজন প্রাজ্ঞ অভিভাবক হারালাম। এমন সদাহাস্যময়, সদালাপী,সঙ্গীতজ্ঞ আর পাওয়া যাবেনা।”
শুভাশিসবাবু বছর পাঁচেক আগেই অবসর নিয়েছিলেন সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। খড়গপুর জংশনের মত স্টেশন সামলেছেন তিনি। অথচ সেই প্রেস্টিজিয়াস পেশার অহংকার তাঁর ছিলনা কোনও দিন। খড়গপুরের প্রবীণ নাগরিক তথা ট্রাফিক রিক্রিয়েশন ক্লাবের অন্যতম কান্ডারি অজিত গুপ্ত জানালেন, ‘ কি বলব খুঁজে পাচ্ছিনা। এমন সহজ সরল অনাড়ম্বর মানুষ আর পাওয়া যাবেনা। বাংলা গানের এত বৈচিত্র্যময় সংগ্ৰহ ছিল তাঁর গলায়। কত মানুষকে সে আড়ালে সাহায্য করে গেছে তা কেউ জানতনা। তার বহু ছাত্রছাত্রী ছিল যাদের বেতন দেওয়ার ক্ষমতা ছিলনা কিন্তু তারজন্য কাউকে গান শেখা ছাড়তে হয়নি। শুধু আমাদের ট্রাফিক রিক্রিয়েশন ক্লাবই নয় খড়গপুরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তার মানবিক সাহায্যের দরাজ হাত বাড়িয়ে দেওয়া থাকত। আর সাংস্কৃতিক আসর থেকে নির্ভেজাল আড্ডায় ওর জুড়ি ছিলনা। একবার সম্বলপুরের এক অনুষ্ঠানে কয়েকজন শিল্পী নিয়ে গিয়েছিলাম খড়গপুর থেকে। শুভাশিসকেও নিলাম। গোটা রাত ও একাই মাতিয়ে রেখেছিল আমাদের। খুব মিশ করছি ওকে, আর যতদিন বাঁচব, মিশ করব।”
খড়গপুরের আরেক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব মিন্টু চৌধুরী বলেন, ‘ সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে যে। এই শুনেছিলাম ও ভালো হয়ে উঠছে। পাশাপাশি কাজ করেছি। ও কন্ট্রোল আর আমি কমার্স। ওর স্ত্রী ডিআরএম অফিসে পাশ ক্লার্ক। তারপর খড়গপুর স্টেশন ম্যানেজার! কতবড় পদ, কত মর্যাদার পদ কিন্তু সেই অমলিন হাসি মিলিয়ে যায়নি পদের অহংকারে। অমন দরাজ গলা। একে একে শূন্য হয়ে যাচ্ছে সব। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা শুভাশিস নেই।’
খড়গপুরের শঙ্খমালা নামক সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক, আবৃত্তিকার কৃশানু আচার্য বললেন, ‘আমাদের সহ সভাপতি, আমাদের অভিভাবক হারালাম। সংগঠনের সঙ্গীত বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতেন শুভাশিস দা। এত ধরনের, এত বৈচিত্র্যময় গানের সংগ্ৰহ আমার মনে হয় এই জেলা বা তার বাইরেও অনেকের কাছেই নেই। দুঃখ দিতে জানতেন না, নিতেও পারতেননা। কষ্ট পেলে দুরে সরে যেতেন নীরবেই। কাউকে বুঝতেই দিতেননা। আজকের সাংস্কৃতিক দুনিয়ার চালাকি, বাগাড়ম্বর সর্বস্বতা, হামবড়াই ভাব থেকে অনেক দুরে থাকতেন মানুষটা।”
বাংলা পুরাতনি গান, অতুলপ্রসাদ কিংবা দ্বিজেন্দ্রগীতি, ভক্তিগীতি, নজরুল অথবা নিজের ভালো লাগা রবীন্দ্র সঙ্গীত অবলীলায় খেলিয়ে যেতেন নিজের গলায়। একসময় তালিম নিয়েছেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে। রেলে চাকরি করতেন বলে গানের স্কুল করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কাছে গান শিখে গাইয়ে হয়ে গেছেন অনেকেই। এক অসম্ভব প্রাণশক্তির আধার, নানাবিধ কর্মকান্ডের এই মানুষটিকে হারিয়ে কিছুটা হলেও অনাথ হয়ে গেল খড়গপুর। গত বছর কোভিডে খড়গপুর হারিয়েছিল সঙ্গীতের আরেকগুরু বিশ্বনাথ অধিকারীকে, হারিয়েছিল সঙ্গীত শিল্পী তথা চিকিৎসক গৌরাঙ্গ বিশ্বাসকে। কিছুদিন আগেই চলে গেলেন চিকিৎসক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী আর বুধবারের রাতকে আরও গাঢ় করে শুভাশিস চক্রবর্তী।
খড়গপুরের বাসিন্দা তথা ইন্দা স্পন্দন ক্লাবের সদস্যা সোনালী মিত্র তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “আমরা স্পন্দন ক্লাবের প্রত্যেকেই হারালাম একজন অভিভাবককে…খড়্গপুর হারালো একজন সঙ্গীতগুরুকে!দাদা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন… আপনার অমৃতলোকের পথে রইল আমাদের প্রত্যেকের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।” সবারই মনে শুধু একটাই প্রশ্ন, আর কত?