নিজস্ব সংবাদদাতা: কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন বৃদ্ধ। বার্ধক্য জনিত অসুখ, ঠান্ডা লাগা, সর্দি কাশি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়। হতদরিদ্র পরিবারটি বৃদ্ধের অন্তিম সৎকারের জন্য গ্রামের প্রতিবেশীদের দুয়ারে দুয়ারে গেলেও সৎকারে এগিয়ে আসেননি কেউ। মৃত বৃদ্ধেরছেলে যখন অকুল পাথারে তখনই এগিয়ে এলেন গ্রামের মুসলিম প্রতিবেশীরা। হাতে হাতে লাগিয়ে গাছ চিরে কাঠ বের করে চিতা সাজানোর কাঠ বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা। কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার দুরে এমনই এক মানবিক সৌভ্রাতৃত্বের নজির হয়ে রইল পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার একটি গ্রাম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে দাসপুর থানার মামুদপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত সেই বৃদ্ধের নাম বলাই রানা। ৮২ বছরের বৃদ্ধ বলাইবাবুর মৃত্যু হয় মঙ্গলবার সকালে। মৃতের ছেলে সুকুমার রানা, পেশায় রাজমিস্ত্রি। এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে যুক্ত হয়েছে লকডাউন জনিত কর্মহীনতা। প্রতিবেশীরা সাহায্য না করলে গাছ কেটে চিতার কাঠ কিংবা শ্মশান অবধি মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই বাবার সৎকারের জন্য প্রতিবেশীদের কাছে যান সুকুমার কিন্তু প্রতিবেশীরা রাজি হননি সৎকার কাজে অংশ নিতে। তাঁদের ধারণা ওই বৃদ্ধের করোনায় মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেশীরা দাবি করেন ওই বৃদ্ধের করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। তারপরেই তাঁরা সৎকার কার্যে হাত লাগাবেন।
সুকুমার জানিয়েছেন, বাবার করোনা হয়নি জানতাম কারন বাবা গত একমাস বিছানা ছেড়ে ওঠেননি আর আমরাও বাড়ির বাইরে যায়নি। তবুও প্রতিবেশীদের কথা মেনেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। কারন আমার মনে হয়েছিল বিষয়টা সন্দেহাতিত হওয়া দরকার। চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিক ভাবে বাবার সোয়াব নিয়ে করোনা পরীক্ষা করেন আ্যন্টিজেন পদ্ধতিতে। দেখা যায় বাবা নেগেটিভ। এরপর নিশ্চিন্ত হয়ে আমি আবারও প্রতিবেশীদের কাছে যাই এবং অনুরোধ করে এবার বাবা সৎকার কার্য করতে কিন্তু না, এবারও এগিয়ে আসেননি তাঁরা। পরীক্ষা ভুল হতে পারে অনুমান করে তাঁরা এড়িয়ে যান এবারও।
ঘটনায় হতবাক বৃদ্ধদের পরিবার যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখনই ঘটে যায় সেই অভূতপূর্ব ঘটনা। খবর পেয়েই ছুটে আসেন মুসলিম প্রধান গ্রামের মুসলিম প্রতিবেশীরা। তাঁরা বলে সৎকার কার্যে আমরা অংশ নিতে পারবনা ঠিকই কিন্তু সাহায্যতো করতে পারব। গাছ কেটে কাঠ চেরাই করা, হাতে হাতে সেই কাঠ চিতা সাজানোর জন্য বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজ গুলো করে দিলেন তাঁরাই। মুসলিম প্রতিবেশী সেক তাজ মহম্মদ, আখতার আলি, পিয়ার আলি, রবিউল আলি, সিরাজ খাঁনের মত মানুষেরা এগিয়ে এলেন
তাঁদের “বলাই কাকা”র সৎকারে সাহায্য করতে। তাঁদেরই সহযোগিতায় দাহ কার্য সম্পন্ন হল মামুদপুর শ্মশানেই।
পুরো ঘটনায় সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য খোকন খাঁন। খোকনবাবু স্থানীয় তৃনমূল নেতা। বললেন, ‘ দেখুন উনি যদি পজিটিভ হতেন তাহলে কী হাসপাতাল দেহ ফেরত দিত? যখন নেগেটিভ হয়েই গেছে তখন দাহ করতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া আমরা দাহ করার অধিকারী নই, করিও নি। এই সৎকার বিষয়টি নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে। আমরা তাঁদের ধর্ম অনুসারে সেই সৎকার করতে সাহায্য করেছি। এই কাজে হাত লাগাতে গিয়ে তাজ মহম্মদ বলেন, ‘ নিজের আব্বা চাচাদের সঙ্গেই একসময় ওঠাবসা করতে দেখেছি বলাই কাকাকে। তাঁর দেহ দাহ হবেনা এমনটা হয়? তাই সবাই মিলে হাত লাগলাম।”
ভাষা নেই সুকুমারের, নেই কারও প্রতি অনুযোগ, অভিযোগ। বাবার শেষ কার্য করার পর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন রবিউল, পিয়ার, সিরাজদের হাত ধরে। বলেছেন, “কী দিয়ে শোধ করব এই কৃতজ্ঞতার ঋণ। আজ এঁদের হাত ধরেই বাবার শেষকৃত্য হল। আমার বাবার সদগতি করে দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের এই দয়ার মূল্য চোকাবো কী দিয়ে? এতো টাকা পয়সা নয় যে গায়ে গতরে খেটে শোধ করে দেব……” যদিও গোটা বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কিছু বলতে রাজি হননি সুকুমারের স্বধর্মের প্রতিবেশীরা।