নিজস্ব সংবাদদাতা: চলতি পক্ষে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যে মরণ কামড় দেবে তা বারবার সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মানুষ সতর্ক হয়েছে কী? এখনও মাস্কহীন বেপরোয়া ভ্রমন চলছেই। বাজার ঘাটে নিরাপদ দূরত্ব ছাড়াই উপচে পড়া ভিড়। ফলে যা হওয়ার হচ্ছে, আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। ৮ই মের হিসাব বলছে শুক্রবার ও শনিবারের মধ্যে মেদিনীপুর ও খড়গপুর শহরে অন্ততঃ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা অথবা করোনার উপসর্গ নিয়ে। খড়গপুর শহরের দুটি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে সাউথ ইন্দা বা সাঁজোয়াল আর অন্যটি তালবাগিচা থেকে। মেদিনীপুর শহরের চারটি মৃত্যুর খবর এসেছে হবিবপুর, পাটনাবাজার, বড়বাজার ও মল্লিকচক থেকে।
খড়গপুর শহরের সাউথ ইন্দা বা সাঁজোয়ালের পার্থ দাশগুপ্ত যিনি ওই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে পার্থ স্যার নামেই পরিচিত ছিলেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে ৭ই মে বা শুক্রবার বেলা দেড়টা নাগাদ শালবনী করোনা হাসপাতালে । কোভিড পজিটিভ চিহ্নিত হওয়ার পর ৫ মে প্রথমে খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি হন পার্থবাবু। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমতে থাকায় শালবনী স্থানান্তরিত করা হয়। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন ৭ই মে বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ সব ঠিকঠাক ছিল। খাওয়া দাওয়া করেছিলেন, কথাও হয়েছিল পরিবারের সদস্যের সঙ্গে। তারপরই হঠাৎ হাসপাতাল খবর পাঠায় আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁকে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যায় ৬৩ বছরের পার্থবাবুর।
তালবাগিচার ৬৫ বছরের এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে কোভিড উপসর্গ নিয়ে শনিবার সকালে। মেদিনীপুরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে। কিছুদিন আগেই ভিন রাজ্যের মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরেন মহিলা। দাঁতের সমস্যার জন্য দাঁত তুলেছিলেন। এরপর হঠাই শ্বাসকষ্ট, জ্বর। দু’দিন আগেই নিয়ে যাওয়া হয় ওই নার্সিংহোমে। ভালই ছিলেন কিন্তু শনিবার রাতে অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। এরমধ্যেই তাঁর করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু তখনও রিপোর্ট আসেনি। রাতে সঙ্কট বাড়তে থাকে। পরিবারের পক্ষ থেকে নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষর কাছে মহিলাকে দ্রুত আইসিইউতে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলে কর্তৃপক্ষ জানান, কোভিড রোগী ছাড়া কাউকেই আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। এটাই বর্তমানে সরকারের নিয়ম। শনিবার সকালে মৃত্যু হয় মহিলার। পরিবারের প্রশ্ন কারুর প্রয়োজন হলেও কোভিড রোগী ছাড়া কাউকে আইসিইউ দেওয়া যাবেনা! এ কেমন নিয়ম? পরিবারের দাবি আইসিইউতে নিয়ে গেলে যে রোগী বেঁচে যেতেন !
শুক্রবার রাত ও শনিবার সকালের মধ্যে মেদিনীপুর শহরে মারা গেছেন চারজন। এরমধ্যে রয়েছেন হবিবপুরের একজন ৬১ বছরের ব্যক্তি। করোনা আক্রান্ত হয়ে শালবনীতে ভর্তি হয়েছিলেন দুদিন আগেই। মল্লিকচকের মাত্র ৩৭ বছরের যুবক অতনু পাল পারিবারিক সূত্রেই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই তাঁর বড়বাজারের বাসিন্দা এক পরমাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছিল করোনাতেই। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে মৃত সেই যুবকের দেখভাল করতে গিয়েই অতনু আক্রান্ত হতে পারেন বলে অনুমান। অতনু প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার একটি দামি নার্সিংহোমে। কিন্তু কয়েকদিন সেখানে থাকার পর তাঁকে আনা হয় মেদিনীপুর শহরের একটি নার্সিংহোমে। এখানেই শনিবার মৃত্যু হয় অতনুর। এই দিনই মৃত্যু হয় বড়বাজারের আরও এক ব্যবসায়ী পুত্রের।
এদিন আরও একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছে মেদিনীপুর শহর। শহরের এক প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা ব্যবসায়ীর ভাইপোর। বছর পঁয়তাল্লিশের এই ব্যক্তি গত কয়েকদিন ধরেই শালবনীতে ভর্তি ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা আরও ভালো চিকিৎসার জন্য তাঁকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের করে আ্যম্বুলেন্সে নিয়ে রওনা হলে পথিমধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে এদিন আরও একজন সরকারি কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে শালবনী হাসপাতালে। এই মৃত্যু ধরলে মৃতের সংখ্যা ২৪ ঘন্টায় ৭জন।
এদিকে জেলার সর্বোচ্চ সুবিধাযুক্ত শালবনী করোনা হাসপাতাল প্রায় টই-টম্বুর। বিশেষ করে এইচডিইউ, আইসিইউ এবং ভেন্টিলেশনে শয্যা খালি নেই বললেই চলে। শনিবার রাতে ২০০ শয্যার হাসপাতালে রোগী রয়েছেন ১৬৩ জন। এরমধ্যে উন্নত সুবিধাযুক্ত ৮০টি শয্যা অর্থাৎ ৫০টি এইচডিইউ, ২০টি আইসিইউ এবং ১০টি ভেন্টিলেশন পরিপূর্ণ। বাকি শয্যাগুলিতে কেবলমাত্র অক্সিজেনের সুবিধা রয়েছে। জেলার সমস্ত কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা কার্যত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছেন কিন্তু রোগীর চাপ বাড়ছে।
৮ই মের হিসাব অনুযায়ী ডেবরা কোভিড হাসপাতালের ৪০টি শয্যার ১৮টি, খড়গপুর মহকুমা কোভিড হাসপাতালের ৫০টির মধ্যে ১৯টি, মেদিনীপুর মেডিকেলের ২৬টির ২টি, আয়ুস হাসপাতালের ১০০টির মধ্যে ৯৫টি, ঘাটালের ৮০টি শয্যার মধ্যে ২১টি খালি রয়েছে। যদিও মনে রাখা দরকার সঙ্কটাপন্ন রোগীর জন্য একমাত্র শালবনী ও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজেই উপযুক্ত পরিষেবা দিতে পারে যেখানে কার্যত শয্যা সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখা, নিরাপদ রাখা ছাড়া অন্য কোনোও উপায় নেই। ৮ই মের হিসাব অনুযায়ী শালবনীতে ৩জন, ঘাটাল ও মেদিনীপুর মেডিকেল ২জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শালবনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে ১জনের মৃত্যু হয়।