রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবে কয়েকটি মেয়ের পিঠে লেখা রবীন্দ্র সঙ্গীতের শ্রাদ্ধ করা গোটা পাঁচেক মেয়েকে প্রায় নাকে খত দিয়ে ক্ষমা চাইয়ে বাঙালি ভাবল খুব একটা করিয়ে নেওয়া গেল। আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিচ্ছুটি করার সাহস পাবেনা বাছাধনেরা! রবীন্দ্রনাথ যেন চণ্ডী মণ্ডপের ওপারে থাকা মন্দিরটির ভেতরে অবস্থিত দেবী মূর্তিটি মাত্র। যত নিয়ম কানুন কেবলই তাঁর পুজার মন্ত্রের বিশুদ্ধতা আর আচার আচরনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মন্দিরের অপর দিকে মণ্ডপটিতে বসে যত খুশি বেনিয়ম করা চলে। সেখানে বসে পরচর্চা ,পরনিন্দা, গৃহবধূ, উঠতি তরুনী , গ্রাম্য সালিশি মায় পিটিয়ে মারা অবধি চলে তাতে দেবীর অঙ্গহানি হয়না। দেবীর ভক্তরা স্থিত স্থবির জড় হয়ে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথও যেন তাঁর গানে , কবিতায় , আঁকায়, প্রবন্ধেই স্থিত। আর তার বাইরে যে বৃহত্তর বাঙালি তথা ভারতীয় সংস্কৃতি, যা নির্মানে তাঁরও বৃহত্তম অবদান রয়েছে সেখানে তার কোনও জায়গা নেই। হাট খোলা সেই চণ্ডীমণ্ডপে সকলই চলে, শুধু রবীন্দ্র কলা সমূহ বাঁচিয়ে চল। তাই গোটা কয়েক মেয়ের পিঠে আড়াল জগতের ভাষা কিংবা ঠেকের ভাষায় ‘রবীন্দ্র’ মিশে যাওয়ায় রবীন্দ্র পুরোহিত বাঙালির খুব লেগেছে! এখন ক্ষমা চাওয়ার গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতেই সব শোধবোধ, শান্ত বাঙালি।
প্রশ্ন উঠলনা যে, মেয়েদের পিঠের পোষ্টার (ছেলেদের বুকেও ছিল) কিংবা বার্লে স্কুলের ছাত্রীরা যে ট্রেলারটি দেখাল এবং আগামী কোনো একসময় যে চলচিত্রের মুক্তি হতে চলেছে তার চর্চা (শ্যুটিংও বলা যেতে পারে )এতদিন যাবৎ সমাজের কোন গভীরে চর্চিত হয়ে আসছে? বাঙালির যদি নেহাৎই আত্ম বিস্মরণ না ঘটে থাকে তবে স্মরণ করা দরকার গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক কলেজ সোশ্যালে অশ্লীল নাচা গানা উঠে আসল কি করে ? কোথাও কোনও ঘটনায় এই অশ্লীল নাচা গানার জন্য কেউ শাস্তি পেয়েছে? না, কলেজ কর্তৃপক্ষ, ছাত্রসংসদের প্রতিনিধি, অধ্যক্ষ কারও কিচ্ছু হয়নি।
খিল্লি, খেউড়, বেলেল্লেপনা, লুচ্চামি, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ সমাজে নতুন জন্ম হয়নি, ইতর সংস্কৃতির চর্চা সাধারন সংস্কৃতির চর্চার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবেই চলেছে কিন্তু সেটা তার নিজস্ব জগতে যে জগৎ আড়ালে থাকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেরও অপ সাহিত্যের সেই চর্চাও চলে হলুদ মলাটের আড়ালে। কেউ চাইলে তাকে ঘরে নিয়েই যেতে পারে কিন্তু তা তার নিজস্ব রুচি, তাকে হাট করে বাজারে বেচতে চাইলে যা হওয়ার তাই হয়েছে এবং হয়ে চলেছে।
গত কয়েক বছরে গ্রামীন বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় ‘হাঙ্গামা’ নামক এক অনুষ্ঠান রমরমিয়ে চলছে।
প্রকাশ্য মঞ্চে চটুল গানের সঙ্গে প্রায় পোষাক হীন তরুন তরুনীর নৃত্য। সে নাচ এতই রগরগে যে দর্শকদের সামাল দিতে লাঠি ধারি প্রহরী পুষতে হয় ‘অপকান্ড’ সামাল দিতে। পঞ্চায়েত, পুলিশ, ব্লক প্রশাসন, বিধায়করা কেউ জানেন না ? গ্রামীন সংস্কৃতির নিজস্ব চর্চা যা এতদিন বাঙালির সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে এসেছে তার পরিবর্তে কোন জাহান্নামের চাষ হয়ে চলেছে। আর তলে তলে যখন এই লুচ্চা সংস্কৃতি হাত পা ছড়িয়ে এতটা বড় হয়ে উঠেছে তখন তা আমাদের ঘরের মেয়েদের পিঠে ফোঁড়া হয়ে ফুটে উঠবে কিংবা গানের কলি হয়ে বমি করবে এতে আশ্চর্য্য কী ?
কোন এক রোদ্দুর রায় যখন বাঙালি সংস্কৃতির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বিছানায় মানু্ষের ক্রিয়াকলাপের মাথায় রবীন্দ্রনাথের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠাচ্ছিল তখন তার ইয়োটিউবের ফলোয়ারের সংখ্যা যে দেবব্রত বিশ্বাসকে ছাড়িয়ে যায়। এবং সেটা ছাড়িয়ে যাওয়া অবাকও কিছু নয় কারন চটুলতা চিরকালই সংখ্যায় বেশি হয়। বরাবরই আগাছা দ্রুত বাড়ে।
সমস্যা হল আগাছা যেন পরিবেশকে গ্রাস না করে ফেলে, তাতে সমাজের বৃক্ষ সমূহ ধ্বংস হয়ে পড়ে, নতুন করে গাছ জন্মাতে পারেনা। রোদ্দুর রায়দের চাষ এখন বাঙালি সংস্কৃতির সেই আগাছাকে বাড়িয়ে তুলেছে। সে আগাছা বাড়তে দেওয়া হবে নাকি তার গোড়ায় আরও সার দেওয়া হবে? সেটা বাঙালি ঠিক করুক।
শুধু এটুকু মনে রাখা দরকার যে ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে শুরু করে মোরগ লড়াইয়ের মাঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজালেই বাঙালির সংস্কৃতি বেঁচে যায়না। বাঙালির বৃহত্তর সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটেও যে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁকে রক্ষা করাটাও জরুরি।
রবীন্দ্রভারতীর ঘটনার পর উপাচার্য পদত্যাগ করতে চেয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠালেন। সত্যি সত্যি এ দায় প্রাথমিক ভাবে তাঁরই। তাই পদত্যাগ গ্রহন করাটা জরুরি ছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী প্রথমেই ভাবলেন, আরেকটা অমন উপাচার্য কোথায় পাব ? না, শিক্ষিত মানুষ আছে কিন্তু জোহুজুরি শিক্ষিত চাই। দ্বিতীয়টা বোধহয় ভাবলেন, কী এমন লেখা হয়েছে মেয়েদের খোলা পিঠে যে উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে? না দুটোই ভেবেছেন হয়ত এমনটা নয় তবে দুটোর একটাও যদি ভেবে থাকেন তবে কিন্তু বলতেই হয়, এ জিনিস আসছে বছর আবার হবে, হয়ত বছর অবধি গড়াবে না, তার আগেই।