লোকশিক্ষক শ্রী রামকৃষ্ণ বিনোদ মন্ডল
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর। দিনটা ছিল সোমবার। শুরু হলো চিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন। আর্ট ইনস্টিটিউটের কলম্বাস হলে শতাব্দি চর্চিত যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, তার সারাৎসার হল – ‘যত মত তত পথ’। কোন নির্দিষ্ট ধর্মের জয়গান না করে, সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা ঘোষণা করলেন তিনি।
এই বার্তা তাঁর অন্তরে প্রোথিত করেন, তাঁরই শিক্ষক — তাঁরই গুরু – লোকশিক্ষক শ্রী রামকৃষ্ণ (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ –১৫ আগস্ট ১৮৮৬)। তাই বলা হয়, বিবেকানন্দের প্রতিটি কাজই শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত। শ্রীরামকৃষ্ণ সূত্র, স্বামীজি ভাষ্য।
উনিশ শতকের বাংলায় যখন হিন্দু ধর্ম শতধা বিভক্ত, ক্লেদাক্ত, সংকীর্ণ আচার সর্বস্বতায় নিমজ্জিত, তখন সহজ-সরল গ্রাম্য ভাষায়, লোকায়ত রূপক ও উপমার মাধ্যমে মানুষকে বাঁচার পথ দেখিয়েছেন রামকৃষ্ণ। নীতি কাহিনীর সাহায্যে ধর্মোপদেশ দান করেছেন। তাঁর ‘কাম-কাঞ্চন’ ও ‘কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের বাণী, সর্বধর্ম সমন্বয় বার্তা এবং ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা-‘র আহ্বান বৃহত্তর কলকাতা তথা অবিভক্ত বাংলায় নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে।
রামকৃষ্ণের এই শিবজ্ঞানে জীবসেবা অদ্বৈতবাদী তত্ত্বকে আধার করে স্বামীজি তাঁর সমাজসেবামূলক অভিযানে সামিল হন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন বন্ধু হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা, পীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো তাঁরই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত।
হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রামকৃষ্ণ। বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রাবতী দেবী। পিতৃদত্ত নাম গদাধর। পড়াশোনায় কোনোদিন মন বসতো না। বরং যাত্রার অভিনয়ে অনেক বেশি সাবলিল ও মনোযোগী ছিলেন তিনি। ১৮৪৩এ তাঁর বয়স তখন আট, পিতৃ বিয়োগ হল। বড় ভাই রামকুমার তখন তাঁকে পূজা পদ্ধতি শেখাতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে, গঙ্গার তীরে ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই মন্দিরে নিত্য সেবার কাজে নিযুক্ত হন রামকুমার। দাদার মৃত্যুর পর গদাধর পান পুরোহিতের দায়িত্ব। নতুনরূপে আবির্ভূত হলেন প্রেমের ঠাকুর, পাগল ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা ষষ্ঠবর্ষীয়া সারদা মনির সঙ্গে বিবাহ হল। কিছুদিন গ্রামে কাটানোর পর পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসেন রামকৃষ্ণ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে তোতাপুরি নামক এক সাধুর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি গদাধরের সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব অভিধায় ভূষিত করেন। এরপর কলকাতায় ফিরে এসে জনসমক্ষে তাঁর উপদেশ ও শিক্ষাদান শুরু হয়। আবার ফিরে যেতে হয় বিবেকানন্দের কথায়। তাঁরই স্পর্শে তাঁর অন্তরে যে ‘দয়ার দৃষ্টি’ ছিল তা ‘শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে’ রূপান্তরিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি শিখেছিলেন – ‘দয়াও ছোট কথা।’ মানুষ ঈশ্বরের জীবন্ত রূপ। ঈশ্বরকে কি আমরা দয়া করবার কথা ভাবি? ঈশ্বরের সেবা করে, পূজা করে আমরা ধন্য হই। তাই দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা। মানুষকে ভগবান ভেবে সেবা। কোন মানুষই ঘৃণ্য নয়। যে পাপী সেও আসলে ভগবান।
শুধু নরেন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ নন, তাঁর সঙ্গে নানা সময়ে বেদ পুরাণ-উপনিষদ সহ বিচিত্র বিষয়ে মত বিনিময়ে সামিল হয়েছেন সমাজের নানা অংশের মানুষজন। ধনাঢ্য থেকে শুরু করে বিদগ্ধ পন্ডিত। তিনি নিজে চলে গেছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে, বিদ্যাসাগরের বাড়িতে, এমনকি ব্রহ্মোপাসক কেশবচন্দ্র সেনের বাসায়। গিরিশচন্দ্রের (ঘোষ) সঙ্গে তাঁর প্রাণের যোগ ছিল। ‘চৈতন্যলীলা’দেখতে মথুর ও হৃদয়কে নিয়ে রঙ্গালয়ে যাওয়া তো আজ ইতিহাস। মহেশচন্দ্র গুপ্ত তাঁর উপদেশ ও বাণী গুলিকে ডায়েরি আকারে নথিবদ্ধ করে এক অনুপম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছেন।
রামকৃষ্ণের বাণী প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যাঁরা আস্তিক, ধর্মানুরাগী, তারা তাঁর ব্রক্ষ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যার ব্যাখ্যায় দশকের পর দশক জুড়ে মশগুল। আমজনতা সুকৌশলে বাঁচার রসদ খুঁজে পায় যখন তিনি বলেন – আপনার মতে নিষ্ঠা রাখিও, কিন্তু অপরের মতে নিন্দা করিও না। অথবা, লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। রাজনীতি যখন আজকের সমাজে অন্যতম পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তাদের জন্যও ড্রইংরুমে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত জুতসই বাণী দিয়েছেন তিনি। ১) যদি শাসন করতে চাও, তাহলে সকলের গোলাম হয়ে থাকো। ২) ফোঁস করবে কিন্তু কোনো আঘাত করবে না। ৩) নিজের দায়িত্ব না থাকলে কেউ কোনদিন বড় কাজ করতে পারে না। ৪) নগ্ন যে, তাকে লজ্জা দেবে কে?
মানুষকে সৎ, বিনয়ী, চরিত্রবান হওয়ার জন্য নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। প্রকৃতির নানা উপাচারের দ্বারা তাঁর সুভাষণ সেজে উঠেছে। ‘যে বৃক্ষ ফল দান করে, ফলবান হয়, সে নুয়ে পড়ে, বড় হবে তো ছোট হও।’ কত সহজে অহংকার ত্যাগের মন্ত্র দিয়েছেন তিনি। ‘পাখি আর সাধু সঞ্চয় করে না।’ ভাগ্যিস, আজকের ভারতবর্ষে তিনি আসেননি। ‘মন যেন সাদা কাপড়, যে রঙে ছোপাবে, সেই রঙই হবে।’কত সহজে বহুমাত্রিক বর্ণালী ছড়ায় এই বাণী! আবার প্রকৃত শিক্ষার তাৎপর্য ধ্বনিত হয়, যখন তিনি বলেন, ঝড় উঠলে অশ্বত্থগাছ, বটগাছ, চেনা যায় না, তেমনি জ্ঞানসূর্য উদয় হলে জাতিভেদ থাকে না।’ তিনি আমাদের মত অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী মার্কা দিগ্ গজদের অকপটে সতর্ক করেছেন – ‘যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।’
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই একটি মানুষ ছোট ছোট গল্প, গ্রামজ উপমার সাহায্যে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন। বড় বড় পন্ডিত, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, উকিল নিয়মিত শান্তির খোঁজে তাঁর কাছে যাতায়াত করতেন। তাঁর অসংখ্য শিষ্য মন্ডলী তৈরি হয়। গৃহস্থ শিষ্য। ত্যাগী শিষ্য। নারী শিষ্য। তাঁর অবর্তমানে মূলত ত্যাগী বীর সন্ন্যাসী শিষ্যদের প্রচেষ্টায় রামকৃষ্ণ আন্দোলন আজ বিশ্বে এত জনপ্রিয়। ভারত ও বহির্বিশ্বে প্রায় ২০০ টি শাখা নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন মানবতার সেবায় নিয়োজিত। যার প্রধান কার্যালয় হাওড়ার বেলুড়মঠ।
এসবের কেন্দ্রে যে মানুষটি, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। মহাপ্রয়াণের দুদিন আগে তিনি বলে যান- ‘দেখ নরেন তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি। কারণ তুই সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। এদের খুব ভালোবেসে, যাতে আর ঘরে ফিরে না গিয়ে এক স্থানে থেকে সাধনভজনে মন দেয়, তার ব্যবস্থা করবি।’ পরবর্তীকালে ‘এঁরাই’ তাঁর জীবন ও দর্শনকে প্রচার ও প্রসারে বিকশিত করেন। এঁরা হলেন- রাখালচন্দ্র ঘোষ (ব্রক্ষ্মানন্দ), কালীপ্রসন্ন চন্দ্র (অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী ( রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (সারদানন্দ) প্রমুখ সন্ন্যাসী।
শ্রাবণের শেষ রাত, রাখি পূর্ণিমা। কাশীপুর বাগানবাড়িতে রামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ ঘটে। বরুণ মহারাজ সহ অনেকেই রামকৃষ্ণের শেষের সেদিন গুলির ধারাভাষ্য দিয়েছেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার অসুখের নাম উল্লেখ করেছেন – ক্লার্জিম্যানস্ থ্রোট। কবিরাজি পরিভাষায় যাকে বলা হয় – রোহিণী রোগ। কাশীপুর পুলিশ স্টেশন প্রদত্ত ডেথ সার্টিফিকেট এর ভাষায় ‘রামকিষ্টো প্রমোহংশ। ‘৪৯ কাশীপুর রোড। মৃত্যুর তারিখ – ১৫ আগস্ট ১৮৮৬। সেক্স – পুরুষ। গতি – ব্রাহ্মণ। বয়স – ৫২। পেশা – প্রিচার। মৃত্যুর কারণ – গলায় আলসার।
প্রেমময় ঠাকুরের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজ, গোঁড়া হিন্দু সমাজ এমনকি বৈষ্ণব থেকে বাংলার বাউল ও কর্তাভজা সমাজেও আলোড়ন ওঠে। তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন – ‘অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে – কাম ক্রোধ বশ করতে কষ্ট হয় না। বরুণ মহারাজ কাশীপুরে ঠাকুরের শেষ জন্মোৎসব উদযাপনের একটি টুকরো খবরও সত্যনিষ্ঠায় পরিবেশন করেছেন। সেদিন উপহার পাওয়া একজোড়া চটি খোয়া যায় ঠাকুরের। তার বদলে ঠাকুরকে যে চটিজোড়া কিনে দেওয়া হয়, তা আজ বেলুড় মঠে পূজিত হয়। সাধেই কি তিনি বলতেন – ‘পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রম্ভ পড়ে কাঁদে!’