নিজস্ব সংবাদদাতা: ঘটনার নৃশংসতা হার মানাবে থ্রিলার সিনেমাকেও। এক ব্যক্তির হাত-পা কেটে, চোখ উপড়ে খালে ভাসিয়ে দেওয়ার পর দেড় কিলোমিটার দুরে গিয়ে আটকে যাওয়া সেই দেহ তুলে তাঁর মাথা আলাদা করে ফের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল খালের জলে। মুণ্ডুহীন সেই দেহ পরে পুলিশ উদ্ধার করে ১২কিলোমিটার দূর থেকে। সেই নৃশংসতার বিচার শেষ হল ৩৫ বছর পর। এর মধ্যে ৭ জন আসামির মৃত্যু হয়েছে বিচার চলাকালীন। বাকি ৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করলেন মেদিনীপুর ফার্স্ট ট্র্যাক আদালতের তৃতীয় এজলাসের বিচারপতি উত্তম ভট্টাচার্য।
এই ৯জন সাজাপ্রাপ্ত হলেন, সেক মেহবুব,সেক ইলিয়াস, সেক আই সেন, আবেদ ঢালি, সেক জালাল, সেক আলাউদ্দিন, সেক জয়নুদ্দিন, কুরবান ঢালি, রমজান ঢালি । ঘটনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার রঘুনাথপুর গ্রামে। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৭তারিখ। অকাল বন্যায় ভাসছে ঘাটাল। এর বাড়ি ওর বাড়ি জলে ভাসছে। সেই সময় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বচসা, মারামারি। ঘটনায় গুরুতর আহত হন এক ব্যক্তি। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাঁকে। কয়েকদিন পরে মৃত্যু হয় তাঁর কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় এই নৃশংস খুনের ঘটনা।
যে ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন তাঁর দলবল এবার চড়াও হয় নুর ইসলাম বলে এক ব্যক্তির বাড়িতে। নুর এবং তাঁর আরও দুই ভাই ঘরে ঢুকে যায়। সেই বাড়ি ঘেরাও করে রাখে বিপক্ষের দলবল। পরের দিন ২৮তারিখ ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নুর সহ তিন ভাই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালায়। ঘেরাও করে রাখা দলটি তাঁদের ধাওয়া করে। চারদিকে বন্যার জল। সেই জল সাঁতরে ২ভাই পালিয়ে গেলেও পালাতে পারেনি নূর। সে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে পাঁচু দোলাই বলে একজনের ঘরে ঢুকে পড়ে।
সরকারী আইনজীবী শেখ রজব আলি জানান, ‘পাঁচু দোলাইয়ের বাড়ির ভেতরে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে নুর। একটি মশারি জড়িয়ে পড়ে থাকে নিজেকে আত্মগোপন করতে। কিন্তু ১৬ জন আক্রমণকারীরা তাঁকে খুঁজে বের করে বাইরে আনে। তাঁর হাত পা কেটে ফেলা হয় তরোয়াল দিয়ে। দুটো চোখ উপড়ে নেওয়া হয় এবং পরে ঘাড়ে উপর্যপুরি টাঙ্গি দিয়ে আঘাত করা হয়। মৃত্যু হয় তাঁর। এরপর খুনিরা কলাগাছের ছাল দিয়ে তাঁর দেহ বেঁধে ভাসিয়ে দেয় স্থানীয় ‘গোরা’র খালে।
সরকারি আইনজীবীর সহকারি জুনিয়ার আইনজীবী আজিজুল হক জানান,’ পরের দিন খবর আসে দেহটি দু’কিলোমিটার দুরে চকপরিন্দর গ্রামের বাঁশের সাঁকোতে আটকে রয়েছে। আসামীরা ফের সেখানে যায় এবং এবার ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথাটি দেহ থেকে আলাদা করে ফের একই ভাবে খালে ভাসিয়ে দেয়। এরপর ৭দিন পরে দেহটি মেলে ১২কিলোমিটার দূরে এলাচক গ্রামে। একটি বাবলা গাছে দেহটি আটকে ছিল। ঘাটাল পুলিশ সেই দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। দেহ সনাক্ত করেন নুরের মা।’
অন্য আরেক সহকারি জুনিয়ার উকিল টি. প্রমীলা জানান, ‘পুলিশ আসামীদের বিরুদ্ধে খুন সহ আরও কয়েকটি ধারায় মামলা রুজু করে। ১৯৯০ সালে মামলা আসে মেদিনীপুর জেলা জজের কোর্টে। সেই মামলা পরে ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে স্থানান্তরিত করা হয়। ২৬ জন স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলাটি চলছিল। এরমধ্যেই ১৬জন আসামীর ৭জনের মৃত্যু হয়। দীর্ঘ শুনানি পর্ব শেষে সোমবার ৯জনকে খুনের মামলায় দোষি সাব্যস্ত করেন বিচারক। বুধবার তাঁদের যাবজ্জীবন ঘোষণা হয়। ‘ কিন্তু কেন লাগলো ৩৫বছর?
সরকারি আইনজীবী সেখ রজব আলি জানান, “নুরের পরিবার এতটাই গরিব ছিল যে তাঁরা আলাদা করে আইনজীবী দিতে পারেনি। সরকারের পক্ষের আইনজীবীই ছিল একমাত্র আইনজীবী। অন্যদিকে বিপক্ষে ২জন নামী উকিল ছিলেন। বিভিন্ন অজুহাতে তারিখ বদল করে নতুন তারিখ নিয়ে মামলাকে প্রলম্বিত করা হয়। ফলে ২০১৩সালে এই মামলার লিখিত আর্গুমেন্ট শেষ হয়ে যায়। এরপর একের পর এক বিচারক বদলেছেন কেউ এই পুরানো মামলায় হাত দেননি। বর্তমান বিচারকের কাছে আমি আবেদন জানাই মামলার নিষ্পত্তির জন্য। তিনি রাজি হন। তারপর ফের শুনানি শুরু হয়। এরপর ১৫৭ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক এই মামলার নিষ্পত্তি করেন।”