সমাজসংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী বিনোদ মন্ডল
ঊনবিংশ শতকে বাংলায় নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন এমন কয়েকজন স্মরণীয় মানুষ বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে প্রথম পরিবারেই পিতার সঙ্গে মতান্তর ও মনান্তর ঘটিয়েছেন। তিনি রামমোহন রায়। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী। এই তালিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন শিবনাথ শাস্ত্রী (৩১ জানুয়ারি ১৮৪৭ — ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯১৯)।
শিবনাথের বাবা সেকালের সমাজে যথেষ্ট কেউকেটা মানুষ ছিলেন। পন্ডিত হরানন্দ ভট্টাচার্য (১৮২৭ – ১৯১২) বিখ্যাত সমাজপতি। জনসেবায় ব্যস্ত এই মানুষটি জয়নগর- মজিলপুর পুরসভার প্রথম পৌরপ্রধান। তিনি ছেলেকে ধর্মপথে ফেরানোর সবরকম চেষ্টা করেন। পিতা-পুত্রের বাদানুবাদ তো চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ছেলেকে নিরস্ত করতে পারেননি। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্ট ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন শিবনাথ। উপবীত ত্যাগ করেন। অস্বীকার করেন মূর্তি পূজা। ক্রোধে হরানন্দ পুত্রকে গৃহ ত্যাগের নির্দেশ দেন। স্ত্রীর হাত ধরে রওনা দেন শিবনাথ।
সারা জীবন মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের (১৮১৯ – ১৮৮৬) স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেছেন। জন্মেছেনও মামা বাড়িতে। গ্রামের আদি নাম ছিল চাংড়িপোতা, বর্তমানে সুভাষগ্রাম। জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা। মামা ছিলেন সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’ এর সম্পাদক। প্রতি সোমবার প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকা ও মামার জীবনযাপন শিবনাথকে বিশাল প্রভাবিত করে। মামার ইচ্ছাতেই তিনি সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৬৬), সংস্কৃত কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৬৮), বি.এ (১৮৭১) এবং সংস্কৃতে এম.এ পাস করেন (১৮৭২)। এম.এ পরীক্ষায় চমকপ্রদ ফলের জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন।তারপর থেকে পিতৃসূত্রে আধারিত ‘ভট্টাচার্য্য’ পদবী পরিত্যাগ করে ‘শাস্ত্রী’ পদবী ধারণ করেন।
একটা ঝোড়ো সময়ে জন্মেছেন শিবনাথ। ছাত্রাবস্থাতেই কেশবচন্দ্র সেনের সান্নিধ্য লাভ করেন। ভেতরে আলোড়ন চলছিল আগে থেকেই। যোগ দেন কেশব বাবুর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে (১৮৬৯)। সমাজে তখন দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের মতের সংঘাত তুঙ্গে। একজন গোঁড়া ব্রাহ্ম। হিন্দু ধর্মের সংস্কারপন্থী। কেশববাবুরা হিন্দু ধর্মকে অস্বীকার করে নববিধানপন্থী। পরে শিবনাথের নেতৃত্বে একদল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৭৮) প্রতিষ্ঠা করেন। কোচবিহারের রাজপুত্রের হাতে নিজের বড় মেয়ে সুনীতিকে সম্প্রদান করেন কেশবচন্দ্র। তাঁর দ্বিচারিতায় সমাজে নিন্দার ঝড় ওঠে। ফলশ্রুতিতে সমাজে আবার ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠন করে চাকরিতে ইস্তফা দেন শিবনাথ। বিশ্বাস করতেন সমাজসেবা করতে হলে হোলটাইমার হতে হবে। অগত্যা শিক্ষকতা ছাড়তে হয়। শিক্ষকতা করেছেন বহু জায়গায়। ভারত আশ্রমের বয়স্কা মহিলা বিদ্যালয়ে। ভবানীপুরের সাউথ সুবারবন স্কুলে। সিটি স্কুলে। হেয়ার স্কুলে। মামা দায়িত্ব দিয়েছিলেন হরিণাভি স্কুল পরিচালনার। সেখানেও মাঝেমধ্যে ক্লাস নিতেন। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে যে সিটি স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, আজ তা সিটি কলেজ রূপে খ্যাতি লাভ করেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসংগঠন — স্টুডেন্ট’স সোসাইটি (১৮৭৯) ভারতবর্ষের প্রথম গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি। নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি মেয়েদের নীতি বিদ্যালয় (১৮৪৮) স্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া নিরন্তর চালু রাখার জন্য সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
কেশবচন্দ্রের অনুগামী হিসেবে সামাজিক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন শিবনাথ। যোগ দেন ইন্ডিয়ান রিফর্মস্ অ্যাসোসিয়েশনে। সমাজে তখন এইসব বিদ্রোহী তরুণের নানা সংস্কারমূলক কাজ আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। মদ্যপান নিবারণ অভিযান চলছে। শুধু একালে নয়, সেকালের বহু গরীব মানুষ মদের আসরে গিয়ে সারাদিনের সব রোজগার উজাড় করে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরত। তাঁরা বাড়ির মহিলাদের একত্রিত করে মদের ভাঁটিতে পর্যন্ত অভিযান চালাতেন। এই সূত্রে উল্লেখ্য শিবনাথ যখন বি.এ. পড়ছেন, তখনই একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করছেন, তার নাম — ‘মদ না গরল’। অসহায় পরিবারের মহিলারা মদ্যপ স্বামীদের হাতে অত্যাচারিত হত। সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত, পরিচারিকার কাজে নিয়োজিত হতো। এখান থেকেই নারী মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার ভাবনা আসে তাঁর মাথায়। বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন, সেকালে এসব আন্দোলনের শরিক ছিলেন তিনিও।
এমনকি মেয়েদের ১৪ বছরের নিচে বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ হোক, এই শ্লোগানে তাঁর কন্ঠও জোরালো ভাবে ধ্বনিত হয়।
শুধু সভাসমিতিতে প্রচার করে ব্যাপক জনসমর্থন সংগ্রহ অসম্ভব ছিল, মানতেন তিনি। তাই জনমত তৈরি করতে পত্র-পত্রিকাকে প্রধান হাতিয়ার করেন শিবনাথ। নানা সময়ে লেখালেখি ও সম্পাদনায় নিয়োজিত থেকেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – সোমপ্রকাশ (১৮৭৩-৭৪), সমদর্শী (১৮৭৪), তত্ত্বকৌমুদী, ইন্ডিয়ান মেসেজ, মুকুল (১৮৯৫) ইত্যাদি। বাংলায় প্রথম কিশোরদের জন্য মাসিক পত্রিকা ‘সখা’ ও প্রকাশ করতেন তিনিই। এইসব পত্রিকার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমানাধিকার, সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে সংস্কার, জাতিভেদ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতেন তিনি। শুধু তাই নয়,সমকালীন বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হাল-হকিকত এখানে তুলে ধরা হতো। এমনকি ভাবতে অবাক লাগে, সেই প্রাক কংগ্রেস যুগে কারিগরি শিক্ষা নিয়েও প্রায়োগিক ভাবনা চিন্তা করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৮৮ সালে, বিলেতে একটানা ছয় মাস কাটিয়ে ছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিকাশ সম্বন্ধে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সংস্কার কর্মসূচিতে যুক্ত করেছেন। সেখানে থাকার সময় সভা-সমিতিতে বক্তৃতা ও আলাপ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। যা তাঁর জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, সাহিত্য সৃষ্টিকে বৈচিত্র্য দান করেছে।
ভাবুক প্রকৃতির এই মানুষটি আচার-আচরণে আদ্যন্ত কবি ছিলেন। সহজ সরল ভাষায় অসংখ্য কবিতা লিখে গেছেন। কিছু কবিতা তো তখনকার দিনে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। যেমন – ‘আজি শচীমাতা কেন চমকিলে/ঘুমাতে ঘুমাতে উঠিয়া বসিলে।’ নম্র স্বভাবের মানুষটি শুধু কবিতায় নয়, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মচরিত, অনুবাদ সাহিত্য ও জীবনী সাহিত্য রচনা করে গেছেন। তাঁর গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৯০৪), আত্মচরিত (১৯১৮), History of brahmo samaj, রামমোহন রায়, ধর্মজীবন (ষষ্ঠ খন্ড, ১৯১৪-১৯১৬), নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্প মালা (১৮৭৫), মেজ বউ (১৮৮০), হিমাদ্রি কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), নয়নতারা (১৮৯৯), বিধবার ছেলে (১৯১৬), ইংল্যান্ডের ডাইরি (১৭৮৮), গৃহ ধর্ম, ছায়াময়ীর পরিণয় (১৮৮৯) জাতিভেদ, সাহিত্য রত্নাবলী ইত্যাদি। এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত সৃষ্টি রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থটি। আজও যেকোনো সাহিত্য ও ইতিহাসের গবেষক, যিনি 1971 নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, এই গ্রন্থ তাকে পড়তেই হয়। গ্রন্থের ভূমিকায় শ্রী শাস্ত্রী লিখেছেন,’ডিরোজিওর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে যদি কেহ গুরুর সমগ্র ভাব পাইয়া থাকেন, তবে তাহা রামতনু লাহিড়ী।’এভাবেই গুরু- পরম্পরায় ডিরোজিওর ভাবনা ও কাজের উত্তরাধিকার বহন করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য তাঁর Men I have seen গ্রন্থটিও।
শিবনাথ শাস্ত্রী অনুভব করতেন পরাধীন জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া কোন সংস্কারই সম্পূর্ণ নয়। তাই তিনি ধারাবাহিকভাবে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। ‘ঘননিবিষ্ট” (১৮৭৭) নামে একটি গুপ্ত বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তা উঠে যায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী প্রমুখদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬) প্রতিষ্ঠা করেন। যা রাজনৈতিক মত ও পথের এবং ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ইস্যু ভিত্তিক আলোচনার দিগন্ত উন্মোচিত করে। এই আলোর রেখা ধরেই ১৮৮৫ তে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়।