অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী বিনোদ মন্ডল
‘না জাগিলে সব ভারত ললনা। এ ভারত বুঝি জাগে না, জাগে না।’ এই অসাধারণ উদ্দীপক পংক্তিমালা সৃজক– বাংলায় উনবিংশ শতকে নবজাগরণের অন্যতম লড়াকু সেনাপতি অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী (২০ এপ্রিল ১৮৪৪ — ২৭ জুন ১৮৯৮)। মাত্র ৫৪ বছরের বর্ণময় জীবন। কিন্তু অফুরন্ত জীবনীশক্তি, নিত্য নতুন সামাজিক সংস্কারে নিবিষ্ট, প্রতিবাদ প্রতিরোধে অনবরত ক্ষতবিক্ষত এক বরণীয় ব্যক্তিত্ব।
মাও সেতুং এর কালজয়ী উক্তি — নারী তুমি অর্ধেক আকাশ। এই উক্তির আলোকে অবিভক্ত বাংলায় নারীকে মুক্তাঙ্গনে শামিল করার লক্ষ্যে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন দ্বারকানাথ। ১৮৬৯ সালে এই উপলক্ষে প্রকাশ শুরু করেন বিখ্যাত পত্রিকা ‘অবলাবান্ধব’। যাদের বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফোটে না,তাদের বুকে ভরসা এবং মুখে প্রতিবাদের ভাষা দিতে পথে নামেন তিনি। পণ করেন,জীবনে কখনো দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণ করবেন না। কিন্তু ইতিহাসের উপহাস হল – কাদম্বিনী বসু নামক নিজের ছাত্রীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার প্রয়োজনে এই ধনুর্ভাঙ্গা পণ ত্যাগ করেন অনায়াসে। এই ঐতিহাসিক বিবাহবাসরে কাদম্বিনীর আত্মীয়রা অনুপস্থিত ছিলেন। তবে আদি ব্রাক্ষ্মসমাজের নেতারা সহ তখনকার কলকাতার বহু উজ্জ্বল তারকা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। ছিলেন সস্ত্রীক পরাধীন ভারতের প্রথম আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তরুণ রবিবাবু তাঁর ভানুসিংহের পদাবলী থেকে ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ গানটি (কাদম্বিনীর পছন্দমত) পরিবেশন করেন। এই কাদম্বিনী বসুই ইতিহাসে ড: কাদম্বিনী গাঙ্গুলী নামে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কাদম্বিনীকে ডাক্তারি ক্ষেত্রে শীর্ষতম স্হানে দেখতে চেয়েছেন তিনি। তাই প্রায় জোর করে তিন সন্তানের মাকে বিলেতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য প্রেরণ করেছেন।
বাংলায় তখন ব্রাক্ষ্মসমাজের বিকাশের কাল। শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি, বিধিনিষেধ, আচারের নামচায় তাঁরা তখন বন্দি নেই। নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের নানা ক্ষেত্রে। বিশেষত সমাজ সংস্কারে। শিক্ষা প্রসারে। হিন্দু সমাজের নানা কুপ্রথা নিরসনে। এই সময় ১৮৭০সালে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের উদার আহবানে সাড়া দিয়ে বগুলা থেকে কলকাতায় আসেন দ্বারকানাথ। এবার আর শুধু ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকা নয়, ‘সমালোচক’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় ধারাবাহিক কলম ধরেন তিনি। আবার শুধু কাগুজে বাঘ না থেকে সমাজের প্রত্যন্ত মানুষটির পাশে গিয়ে, সরজমিনে তাদের জীবনযাত্রার মান প্রত্যক্ষ করেন। তাদের মধ্যে শিক্ষা সাক্ষরতা, দারিদ্র্য দূরীকরণে, নেশা ত্যাগে প্রচার আন্দোলন শুরু করেন। বিশেষত নারী শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
১৮৭৩ সালে কলকাতায় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেকালে অভিভাবকদের কাছে হত্যে দিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করা কম ঝুঁকির ছিল না।তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ছাত্রী নিবাস চালু করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেন। সেখানে শিক্ষকতা করতেন নিজে। যদিও বছর আড়াই চলার পর তা উঠে যায়। কিন্তু হতাশ না হয়ে ১ জুন ১৮৭৬ – এ সহযোগীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়।এই বিদ্যালয়ের দ্বার উদ্ঘাটন করেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।এই সূত্রে বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যাতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে পারে, সেই লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন তিনি। তখনো বাংলায় মেডিকেল কলেজে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এ বিষয়ে উদ্যোগী হন তিনি। কাদম্বিনী বসু ভাগলপুর থেকে এসে তাঁর স্কুলে ভর্তি হয়। তাঁর দু’বছর পরে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৮৭৮ সালের ১ আগস্ট বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে যায় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়। শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, অন্নদাচরণ খাস্তগীর এবং আনন্দমোহন বসু প্রমুখ ব্রাক্ষ্ম নেতা যতটা না ধর্মসংস্কারে ব্যাপৃত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি শিক্ষা সংস্কারে বিশেষতঃ নারী শিক্ষা প্রসারেও ব্যস্ত হয়ে যান। ব্রাক্ষ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের যখনই অর্থ কষ্ট দেখা দিয়েছে, তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের জীবন বিমার সার্টিফিকেটও একবার তুলে দিয়েছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর হাতে। যদিও সে প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
ছাত্রীরা এগিয়ে যাক, মানুষ হোক্, এই চিন্তা সবসময় তাকে পাগলের মতো তাড়া করতো। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে একটি নাটক লেখেন ‘বীর নারী’ শিরোনামে। পাঠ্যপুস্তক এর অভাব মেটাতে নিজের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান নিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনায় হাত দেন। সরল পাটিগণিত, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্ব লেখেন।এছাড়াও নানা সময়ে রচনা করেছেন জীবনালেখ্য, কবি গাঁথা, নববার্ষিকী প্রভৃতি গ্রন্থ। এমনকি উপন্যাস লেখেন – ‘সুরুচির কুটির’। পরাধীন দেশের মানুষকে জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে জাতীয় সংগীতের একটি সংকলনও করেন তিনি।
ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মাঝে মাঝেই মতান্তর হত তাঁর। সমাজের রীতি-নীতি পালন, ধর্মীয় অধিবেশনে যোগদান, বেদ পাঠ ইত্যাদির থেকে তিনি বরাবর প্রায়োরিটি দিতেন সমাজ সংস্কারে। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে। কেশব বাবু আবার এতোখানি মাতামাতি পছন্দ করতেন না। ফলতঃ সমাজে সংঘাতের একটা পরিবেশ ছিলই।এরপর যখন নিজের মেয়ের স্বার্থের কথা ভেবে কোচবিহারের রাজকুমারের সাথে সুনীতির হিন্দু মতে বিয়ে দেন কেশবচন্দ্র, তখন প্রতিবাদ করেন দ্বারকানাথ। শুধু তাই নয়, ‘সমালোচক’ নামে (সম্পাদক নিজেই) পত্রিকায় এই ঘটনার প্রতিবাদে তীব্র সমালোচনা করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সমাজে আলোড়ন ফেলেছিল। শুধু প্রতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নয়, নানা সময়ে যেখানেই যখন কোন অসহায় মেয়ের সন্ধান পেয়েছেন, তাকে ধরে এনে পুনর্বাসন দিয়েছেন তিনি, ভর্তি করেছেন নিজেদের বিদ্যালয়ে। ‘অবলাবান্ধব’ নামের যথার্থ প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। শোনা যায়,বিনোদিনী দাসীও কিছুদিন ছদ্মবেশে তাঁর বাসার পাশে ভাড়া থেকে মেডিকেল পড়ুয়া কাদম্বিনীর হাতে চিকিৎসিত হয়েছেন। তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছাড়া সেকালের সমাজে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না।
তদানীন্তন কলকাতায় তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক নেতাও। বিশেষতঃ ভারতীয় চা শ্রমিক বা কুলিদের আন্দোলনের অগ্রণী নেতা ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন রামকুমার বিদ্যারত্ন। ‘সঞ্জীবনী’পত্রিকায় অসমের চা বাগানের কুলিদের দুরবস্থা নিয়ে লাগাতার নিবন্ধ রচনা করতেন বিদ্যারত্ন। সেই সব লেখার গ্রন্থ রূপ হল – ‘উদাসীন সত্যশ্রবার অসম ভ্রমণ’ ‘কুলি কাহিনী’। দেখা যাচ্ছে শেষোক্ত গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী নাম যোজন করেছেন রামকুমার বিদ্যারত্ন। এবার দ্বারকানাথ নিজেই চলে যান আসাম। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকেন। কুলিদের বেশে বস্তিতে যাতায়াত করেন, তথ্য সংগ্রহ করেন। ‘আসামে লেগ্রির সন্তান’ নামে ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় সেই সব তথ্য প্রকাশ করতে থাকেন। এছাড়াও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘The Bengali’ পত্রিকায় ‘slave trade in Assam’ শিরোনামে ১৩ কিস্তি লেখা ছাপা হয় তাঁর। কুলিদের স্বার্থে চা বাগানের মালিকদের বিরুদ্ধে চলা মামলায় অর্থ সাহায্য করতেন তিনি। উকিলের ব্যবস্থা করতেন। তাদের আইনি পরামর্শ দিতেন সাধ্যমত।
এই কুলিদের জন্যই রাজনীতিতে সময় দেওয়া শুরু করেন তিনি। অনেক গবেষকের এমনই ধারণা। তবে কথাটি অর্ধসত্য। কেননা ছাত্রসমাজ, ভারত সভা প্রভৃতি সংগঠনের কাজে সক্রিয় ছিলেন আগে থেকেই। একক উদ্যোগে ভারত সভার পক্ষ থেকে একাধিক ইশতেহারও প্রকাশ করেন। সেই সূত্রে ১৮৮৭ তে জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে কুলিদের ওপর সংঘটিত অত্যাচারের বিষয় নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করেন। যদিও অধিবেশনের কার্যকর্তাগণ দ্বারা তা প্রাদেশিক সমস্যা বলে উপেক্ষিত হয়। তবে, তাঁর নাছোড় মানসিকতার জন্য ১৮৮৩ তে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশনে বিপিনচন্দ্র পালের অনুরোধে তিনি মঞ্চে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পান। তথ্যসমৃদ্ধ সেই আলোচনার পর ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে শুরু করে। ১৮৯৬ সালে বিষয়টি জাতীয় স্তরের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত ও নিরূপিত হয়।
একজন দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। তার ফলশ্রুতিতে ১৮৮৯ তে অনুষ্ঠিত বোম্বাই অধিবেশনে কাদম্বিনীর নেতৃত্বে মাদাম কামাসহ কয়েকজন মহিলা প্রতিনিধিত্ব করেন। বিচার ব্যবস্থায় বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদ করেন তিনি। আফিম, মদ প্রভৃতি নেশার প্রকোপ রোধে সামাজিক আন্দোলনে প্রয়াসী হন। সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছেন স্ত্রী ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং জামাতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। আর স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী কন্যা জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী।