পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- কথায় আছে লক্ষীর সাথে সরস্বতীর সহাবস্থান হয় না। কিন্তু প্রায় ২২৫ বছর ধরে সরস্বতীর সাথে লক্ষীকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছেন শালবনীর মহাশোলের সিংহ পরিবার। ব্যাবসায়িক কারনে প্রায় ৫০০ বছর আগে বিহারের ছাপরা থেকে সিংহ পরিবারের পুর্বপুরুষ জৈনক সৈজন সিংহের হাত শালবনীর মহাশোলে সিংহ পরিবারের গোড়াপত্তন শুরু হলেও সরস্বতীর সাথে লক্ষীকে একসূত্রে বেঁধে সরস্বতী পূজোর প্রচলন শুরু হয় ঈশান সিংহের হাত ধরে। যা প্রায় ২২৫বছর পরেও সেই ধারা বজায় রেখেছেন সিংহ পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। শুধু পূজোই নয়, এই পূজো উপলক্ষে বসে মেলা, আয়োজন করা হয় হরিনাম সংকীর্তনের। বাড়িতে বাড়িতে আসে আত্মীয় সজন। চলে খাওয়াদাওয়া। সেই আবেগ আর উৎসাহে ভাটা পড়েনি এবারও। অতিমারির আতঙ্ক কাটিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও সারস্বত আরাধনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন সিংহ পরিবারের মানুষ জন। বাড়ির মহিলার ব্যাস্ত চিড়ে আর নলেন গুড় দিয়ে তৈরি নাড়ু বানাতে।
শালবনীর মহাশোল একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে ব্যাবসায়িক কারনে বিহারের ছাপরা থেকে এসে মহাশোল, নদাশুলি ও সূর্যপুর নামে তিনটি মৌজা তৎকালীন জমিদারের করে কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মহাশোলে বসতি স্থাপন করেন সৈজন সিংহ। ব্যাবসা ও চাষবাস করে দিন কাটাতেন। আর অবসর বিনোদনের জন্য এই গ্রামেই গড়েছিলেন একটি আটচালা। এই আটচালাতে বসেই বাড়ির কর্তারা গাল গল্পে মশগুল হতেন। বংশ পরম্পরায় এই ধারা বজায় ছিল। এর পর সৈজন সিংহের নাতি প্রয়াত ঈশান সিংহ এক মাঘের শীতের সন্ধ্যায় বাড়ির কর্তাদের নিয়ে আটচালায় বসে গল্প করছেন। এমন সময় অবিবাহিত দুটি মেয়ে আটচালার পাশে বসে পুজো করতে শুরু করলেন। আটচালায় বসে থাকা ব্যাক্তিরা ছুটে গিয়ে তাদের কাছে যেতে না যেতেই সেই দুই মেয়ে চোখের নিমেষে উধাও হয়ে যায়৷ অনেক খোজাখুজি করেও আর তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কি ঘটলো এই চিন্তা করতে করতেই সকলেই বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঈশান সিংহের চোখে ঘুম নেই। তিনি সেই দুটি মেয়ের কথা ভাবতে লাগলেন। রাত তখন প্রায় শেষ৷ গ্রামের শেষ প্রান্তের বাঁশবাগান থেকে পাখির কলতান শুনতে পারছেন৷ এমন সময় হঠাৎ করেই তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন৷ আর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সেই দুটি মেয়ে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে বলেন আমাদের দুই বোনের পূজো কর, মঙ্গল হবে বংশপরম্পরায়। এই বলেই মেয়ে দুটি ফের উধাও হতে ঈশান বাবুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ঘুম থেকে উঠে দেখেন কোথাও কেউ নেই। স্বপ্নে দেখা সেই দুটি মেয়ের নির্দেশ মতো পুজো করার মনস্থির করেন। বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে খড় আর বাঁশ দিয়ে মন্দির নির্মান করে একই মেড়ে লক্ষী আর সরস্বতী পূজা শুরু করেন। সেই থেকে আজো নিয়ম আর নিষ্ঠা ভরে পুজো হয়ে আসছে সিংহ পরিবারে। তখন পূজো হতো নিয়ম মেনে তিন দিন। পুজো শুরু হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরে পরিবারের সদস্যরা ঠিক করেন পুজো উপলক্ষে আয়োজন করতে হবে হরিনাম। সেই মতো চব্বিশ প্রহর ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় হরিনাম সংকীর্তনের। ফলে মেলা বেড়ে হয়েছে সাত দিন৷ বংশানুক্রমে পূজা চলে আসা এই পুজোর পৌরহিত্য করেন সিংহ পরিবারের পাঁচবংশে’র সবথেকে বয়স্ক পুরুষ। পারিবারিক সেই ধারা বজায় রেখে এবার এই সিংহ বাড়ির পূজোর মূল আহ্বায়ক চিত্তরঞ্জন সিংহ, দুলাল চন্দ্র সিংহ, নিরঞ্জন সিংহ, নেপাল সিংহরা।
তারা জানান বংশানুক্রমিক এই পুজো হয়ে আসছে। বাড়ির কর্তাদের নিয়মনীতি মেনেই পুজো হয়। তবে তখনকার সেই আয়োজনের সঙ্গে বর্তমানে বিস্তর ফারাক হয়েছে৷ হ্যাজাক লাইটের পরিবর্তে এসেছে রকমারী আলোর রোশনাই, কাঁচা মন্দিরের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে সুরম্য পাকা মন্দির, পাকা হয়েছে আটচালা। বসে মেলা, আয়োজন করা হয় নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের । তবে আমাদের এই পুজোর মুল আকর্ষণ হলো বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের হাতের তৈরি চিড়ে আর নলেন গুড় দিয়ে বানানো নাড়ু। বয়সের ভারে কাবু সিংহ পরিবারের সবচেয়ে বয়স্কা আভারাণী সিংহ বলেন, ” প্রায় ৬০ বছর ধরে আমি শ্বাশুড়ির কাছে এই নাড়ু করা শিখেছিলাম শুধু মাত্র এই পুজোর জন্য। আজও সেই ধারা রয়েছে৷ এই নাড়ু দিয়েই আমরা আগত আত্মীয় সজনদের অভ্যর্থনা জানাই”। ফলে পুজোর এইকটা দিন নামেই থাকে সিংহ পরিবারের পুজো কিন্তু আসলে হয়ে উঠে মহাশোল, জগন্নাথপুর, খেমাকাটা, ঝাঁটিয়াড়া,মন্ডলকূপী, শালবনী সহ প্রায় আট দশটি গ্রামের মানুষের মিলন মেলা।