অশ্লেষা চৌধুরী: ১৪ই ফেব্রুয়ারি যখন সারা দেশ ভালবাসা দিবসের মোহে আচ্ছন্ন, সেই সময় দেশের এক প্রান্তের মাটি সিক্ত হয়ে গেল বীর সেনানীদের রক্তে। সন্তান হারা হল মায়েরা, সিথির সিঁদুর খোয়ালেন এঁয়োরা তো কোথাও পিতৃহারা হল ছোট ছোট নিষ্পাপ মুখগুলো। ২০১৯ সালের সেই ভয়ানক ঘটনা আজও সমান ভাবে শিহরিত করে করে হৃদয়।
ঘটনার বিবরন–
প্রায় ২৫০০ জন জওয়ান সহ ৭৮ টি গাড়ি পুলওয়ামা জেলার অবন্তীপোরার কাছে শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। পরিবারের সাথে ছুটি কাটিয়ে সকলেই সেই মিষ্টি-মধুর স্মৃতি বুকে নিয়ে দেশ মায়ের সেবার উদ্দেশ্যে পুনরায় কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যের আগেই গন্তব্যে পৌছানোর কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু তাঁর আগেই ৩টা ১৫ নাগাদ প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাশ্মীরের উপত্যকা। প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি বিস্ফোরক বোঝাই একটি গাড়ি এসে সিআরপিএফ-এর কনভয়ের একটি গাড়িতে ধাক্কা মারে। দুটি বাসে ধরে যায় আগুন। বিস্ফোরণের দাপটে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় জওয়ানদের দেহ, প্রাণ হারান ৭৬ নং ব্যাটালিয়ানের ৪০ জন জওয়ান। আহত হন অনেকেই।
করুন আর্তনাদে ছেয়ে যায় সারা দিক। রক্তে লাল হয়ে ওঠে সাদা বরফের চাদরে মোরা ভূস্বর্গের ঐ এলাকা। এমনকি বিস্ফরণের পর জওয়ানরা লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেও সন্ত্রাসীরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে, বাসের গায়ে থাকা বুলেটের চিহ্ন তার প্রমাণ। ৪০ জন নিহতরা ছিলেন উত্তর প্রদেশ- ১২, রাজস্থান- ৫, পাঞ্জাব- ৪, পশ্চিমবঙ্গ-২, উড়িষ্যায়- ২, উত্তরাখণ্ড- ২, বিহার- ২, মহারাষ্ট্র- ২, তামিলনাড়ু- ২, আসাম- ১, কর্ণাটক- ১, জম্মু ও কাশ্মীর- ১, হিমাচল প্রদেশ- ১, কেরল-১, ঝাড়খণ্ড-১, মধ্য প্রদেশ-১।
সেনা সূত্রে খবর, ২০১৯ সালের ভারতীয় সেনা কনভয়ে হামলা চালানোর ছক কষা হয়েছিল দু’বছর আগেই। এজন্য দু’বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছিল জঙ্গিরা। হামলায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের আফগানিস্তানে অবস্থিত আল কায়দার ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আল-কায়েদার ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে জঙ্গিরা শিখেছিল কিভাবে গাড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে হামলা চালাতে হয়। সেই মতই প্রায় ২০০ কেজি বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি ব্যবহার করে হামলাকারীরা জঙ্গী নাশকতা চালায় উপত্যকা অঞ্চলের সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর। ঘটনার মূল অভিযুক্ত ওমর ফারুক ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ট্রেনিং নেয়। এরপর ২০১৮ সালে ভারতে ঢুকে কামরান, মহম্মদ ইসমাইল, কারি ইয়াসির ও কাশ্মীরের জঙ্গি আদিলদারের সাথে মিলিত হয় পুলওয়ামা হামলার ছক কষে।
জানা যায়, প্রথমে ৬ই ফেব্রুয়ারি হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। গাড়ির দুটি ব্যাগে আরডিএক্স, জিলাটিন স্টিক, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, আইইডি সহ প্রায় ২০০ কেজি বিস্ফোরক বোঝাইও করে তারা। কিন্তু ঐদিন উপত্যকা অঞ্চল বরফে ঢেকে যাওয়ায় পরিকল্পনায় বদল আনে তারা। এরপরে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার হাইওয়ের উপর দিয়ে সেনা কনভয় যেতেই বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা।
এই ঘটনাটি ঘটার পরেই অবশ্য দায় স্বীকার করেছে জইশ-ই-মহম্মদ। জানা যায়, হামলাকারী আদিল আহমেদ দারের নাম। তিনি এই পুলওয়ামারই বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি ওই দলে যোগ দেন। তারপর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটায়। দেশ মা নিজের এতোগুলো বীর সন্তানের প্রাণ হারিয়ে যেতে দেখে । পাকিস্তান যদিও এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি।
ইতিহাস বলছে, বিগত দু দশকে এমন হামলা আর হয়নি। ২০১৫ সালে গুরুদাসপুর থানায় জঙ্গি হামলায় মারা গিয়েছিলেন সাত জন। তারপর ২০১৬ সালে পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলায় মারা গিয়েছিলেন সাত জন। আর তারপরের উরি হামলার কথাও আমরা কেউ ভুলিনি। সেই সময়েও রাতে জওয়ানরা ঘুমোনোর সময়ে অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল সন্ত্রাসীরা, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৮ জন। কিন্তু পুলওয়ামার হামলা সেই সব রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে।
সন্ত্রাসীদের এই কাপুরুষের মতো ও বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সারা দেশ। নিন্দার ঝড় উঠেছিল সমস্ত জায়গায়। চুপ করে বসে থাকেনি সরকারও, যার পরিণতি ছিল ২৬ শে ফেব্রুয়ারি বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক। কিন্তু এত কিছুর পরে আজও একটাই প্রশ্ন উঠে আসে, এতটা কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে কীভাবে গাড়ি বোঝাই এতটা পরিমাণ বিস্ফোরক সেনাবাহিনীর কনভয়ে গিয়ে হামলা চালালো? অত পরিমান বিস্ফোরক সীমান্তে মজুত হল কী করে? এতবড় হামলার আগে কোনোও খবরই পেলনা গোয়েন্দা দপ্তর!এখানেই আমাদের লজ্জা!
তবে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও সমানভাবে শিহরিত করে প্রতিটি দেশবাসীকে। আর তাই তো ভালোবাসা দিবসের এই দিনটি বীর শহীদের জন্যই উৎসর্গ করা হয়েছে ব্ল্যাক ডে হিসেবে।