নিজস্ব সংবাদদাতা: তিন ঘন্টা ১৫মিনিট ধরে আলোচনা, তর্ক, বিতর্কের পরেও রাজি করানো যায়নি সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বকে। সুশান্ত ঘোষকে জেলা সম্পাদক মন্ডলীতে যুক্ত করতে ঘোর আপত্তি জানিয়েই যাচ্ছিলেন তাঁরা। বাধ্য হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিএম নেতৃত্বকে চূড়ান্ত বার্তা দিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম। বললেন, ‘ রাজ্য কমিটি এবং পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্ত যে সুশান্ত ঘোষকে জেলা সম্পাদক মন্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদি তা না করা হয় তবে জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি সাংগঠনিক কমিটি তৈরি করা হবে এবং তার মাথায় বসানো হবে সুশান্ত ঘোষকেই।”
বাস্তবিকই এরপর আর কিছুই বলার ছিলনা সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের। মেদিনীপুর শহরের আলিমুদ্দিন স্ট্রীট বলে খ্যাত মিরবাজারের সিপিএম জেলা দপ্তরে রাত আটটা থেকে শুরু হওয়া এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কার্যত নীরবই ছিলেন তরুণ রায় কিন্তু সুশান্ত ঘোষকে জেলার সম্পাদক মন্ডলীতে যুক্ত করার বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র আপত্তি তিনি ব্যক্ত করেছিলেন জেলা সম্পাদক মন্ডলীর তাঁর অনুগত দুই সদস্য তাপস সিনহা এবং কীর্তি দে বক্সীকে দিয়েই। কিন্তুশেষ অবধি মেনে নিতেই হল উচ্চতর কমিটির সিদ্ধান্ত।
বুধবার মেদিনীপুর শহরের সেই মিরবাজার জেলা পার্টি অফিসে রাত প্রায় ১১টা ১৫ অবধি চলা এই টান টান সভায় একটা অদ্ভুদ সাযুজ্য লক্ষ্য করা গেছে। দুই সম্পাদক প্রায় কোনও কথাই বলেননি! একজন জেলা সম্পাদক তরুণ রায় আর অন্যজন রাজ্য সম্পদক সূর্যকান্ত মিশ্র। অন্যদিকে দুই কমিটির পক্ষে ২জন করে সক্রিয় ছিলেন। রাজ্য কমিটির পক্ষে মহম্মদ সেলিম ও রবীন দেব আর জেলা কমিটির পক্ষে তাপস সিনহা আর কীর্তি দে বক্সী। রাজ্য কমিটির পক্ষে লড়াই সুশান্ত ঘোষকে সম্পদক মন্ডলীতে প্রতিস্থাপন করা আর অন্যদিকে তরুণ রায়দের প্রবল প্রচেষ্টা ঘোষকে আটকানো, যা শেষ অবধি ব্যর্থ হয়।
গত ৬ই ডিসেম্বর প্রায় এক দশকের নির্বাসন কাটিয়ে জেলায় প্রবেশ করেন সুশান্ত ঘোষ। আর জেলায় প্রবেশের দিন থেকেই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি করে চলেছেন তিনি। তাঁকে ঘিরে এক অদ্ভুদ উন্মাদনা তৈরি হয়েছে সিপিএম কর্মী সমর্থকদের মধ্যে। তাঁর প্রতিটি কর্মসূচিতেই মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে।
উল্লেখ্য ২০১১ সালে তৃনমূল ক্ষমতায় আসার পর বেনাচাপড়া ও দাসেরবাঁধ দুটি মামলায় গ্রেপ্তার হন সুশান্ত ঘোষ। এই একই ধরনের মামলায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বহু সিপিএম নেতা অভিযুক্ত হন, এমন কি জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ও। একে একে সমস্ত নেতা জামিন পান কিন্তু সুশান্ত ঘোষকে জামিনের শর্ত দেওয়া হয় যে তিনি আদালতের অনুমতি ছাড়া নিজের জেলায় প্রবেশ করতে পারবেননা। সেই থেকেই জেলার বাইরে ছিলেন ঘোষ। অন্যদিকে তরুণ রায় সহ বহু নেতাই জামিন পেয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করে দেন। কিন্তু সুশান্ত ঘোষ জেলায় ফিরতে পারেননি বলে সরাসরি পার্টির কাজ কর্ম করতে পারেন নি।
যদিও ঘোষ বসে থাকেননি। আইনি নির্দেশ মেনে তিনি জেলায় প্রবেশ না করলেও জেলার বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি দলের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মাশুলও দিতে হয় ঘোষকে। জেলা পার্টিকে অন্ধকারে জেলার পার্টি কর্মী সমর্থকদের জেলার সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় মিটিং ইত্যাদি করছেন ইত্যাদি নানান শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আসে তাঁর বিরুদ্ধে। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানায় রাজ্য কমিটিতে। সাংগঠনিক রীতিনীতি না মানার অভিযোগে শেষ অবধি তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা হয় ৬ মাস নির্বাসনের।
বৃহস্পতিবার সেই নির্বাসনের অবসান ঘটল। এদিন জেলা কমিটির মিটিংয়ে অনুমোদন মিলল যে বুধবার রাতে রাজ্য ও জেলার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুশান্ত ঘোষ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হলেন। এই একই দিনে সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হয়েছেন সুকুমার আচার্য্য। দীর্ঘ দু’দশকেরও বেশি এই জেলা কমিটির সদস্যকে সম্পাদক মন্ডলীতে আনায় সিপিএমের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য সংখ্যা হল ১৮ জনে দাঁড়ালো।
যদিও এখানেই শেষ নয়। পরবর্তী কার্যক্রম হিসাবে অতি শীঘ্রই পশ্চিম মেদিনীপুরের বাইরেও জঙ্গলমহলের একাধিক জেলার দায়িত্বে আসতে চলছেন ঘোষ এমনটাই জানা যাচ্ছে। বিশেষ করে ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়া জেলার নিচু তলার সিপিএম কর্মীরা ঘোষকে চাইছেন বলে জানা গেছেন বিশেষ করে নির্বাচনের মুখে। ঘোষ সম্পাদকমন্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই উচ্ছাসে ফেটে পড়েছেন জঙ্গলমহলের কর্মী সমর্থকরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনন্দনের ঝড় বয়ে গেছে। একাধিক জেলা সামলাতে খুব শীঘ্রই তাঁকে রাজ্য কমিটিতে আনা হচ্ছে এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে।