ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র
বিনোদ মন্ডল উনবিংশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন (১৯.১১. ১৮৩৮ –৮.১.১৮৮৪)। কলকাতার সম্পন্ন বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম। পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেন ছিলেন রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল এর প্রথম ভারতীয় সম্পাদক। বাবা প্যারীমোহন ছিলেন সূক্ষ্ম রুচির আধুনিক মানুষ। মা সরলাসুন্দরী দেবী ছিলেন বিদুষী। বিবেকানন্দের আগে তিনিই একমাত্র মুক্তমনা তার্কিক যিনি শুধু প্রাচ্যে নয়, খোদ রানীর দেশে ইংল্যান্ডে গিয়ে ভারতীয় ধর্মচেতনার ঐতিহ্য প্রচার করেছেন।
১৮৭০ সালে, যখন তাঁর বয়স মাত্র তেত্রিশ, তিনি বিলেত যান। সেখানে ছয় মাস কাটান। নিবিড় ভাবে সে দেশের সমাজজীবন শিক্ষা-সংস্কৃতি -বিজ্ঞানের অগ্রগতির রূপরেখা উপলব্ধি করেন। শহর ও গ্রাম জীবনের বৈশিষ্ট্য গুলি অনুধাবন করে আসেন। যার ফলে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ ও আলোচনায় এক বিশ্বজনীনতার মাত্রা যুক্ত হয়। তিনি সে দেশের রানী ভিক্টোরিয়ার সাক্ষাৎপ্রার্থী হন এবং রানীর সাথে ভারতীয় বেদ-বেদান্ত ও উপনিষদের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন।
১৮৫৭ সালে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান দেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ব্রাহ্মসমাজের ডাকসাইটে নেতা। যশস্বী পন্ডিত ও সুবাগ্মী কেশবচন্দ্র তখনই কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে পরিচিত নাম। বছর খানেকের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথের প্রধান সহযোগী হয়ে ওঠেন নিজের যোগ্যতায়। কিন্তু ব্রাহ্ম সাধনার মত ও পথ নিয়ে উভয়ের চিন্তাভাবনায় মতান্তর দেখা দেয় অচিরে। দু’টুকরো হলো ব্রাহ্মসমাজ। কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (১৮৬৮)। দেবেন্দ্রনাথের সমাজ পরবর্তীকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে অভিহিত হলো। দুজনের মতান্তর এর প্রধান কারণ ছিল সমাজের দার্শনিক ভিত্তি ভাবনায়, সাধনপথে।
কেশবের মুক্ত চিন্তা ও উদ্যমকে দেবেন্দ্রনাথ সমর্থন করতেন। কিন্তু একেশ্বরবাদ সংক্রান্ত আলোচনায় সবার জন্য উদারমনা সংস্কৃতি মেনে নিতে পারেননি দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর মধ্যে একটা অভিজাত ভাব রয়ে যায়। বাছবিচার করে সমাজ গড়তে গিয়ে নিজের ধর্মের অনেককেই যে দূরে ঠেলে দেওয়া হয় এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন কেশব চন্দ্র। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের নাম পরিবর্তিত হয়ে নববিধান ব্রাহ্মসমাজে রূপান্তরিত হয়। বাংলা ছাড়িয়ে বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনি ব্রাহ্মসমাজকে ছড়িয়ে দেন। সারা দেশজুড়ে সংস্কার সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা প্রচার করে যান তিনি। ফলে জীবদ্দশায় শতাধিক শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজের।
সমাজ সংস্কারক হিসেবে কেশবচন্দ্র সেখানে এক অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষত সমাজের অর্ধেক আকাশ যে নারী সমাজ — তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রামে নিরলস ভূমিকা ছিল তাঁর। ৮ বা ৯ বছরের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়ে যেত। এই বাল্যবিবাহ রোধে তাঁরই লাগাতার আন্দোলনের ফলে ১৮৭২ সালে সিভিল বিবাহ আইন পাশ হয়। নানা কারণে তখনকার সমাজে এই আইনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিয়েতে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, নানা ধর্মীয় আচারাদি পালন আর বাধ্যতামূলক থাকলো না। এক বিবাহ বাধ্যতামূলক হলেও হিন্দুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মহত্বপূর্ণ দিক হল ছেলে-মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়সসীমা হল ১৪ এবং ১৮। যা শারীরবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান উভয় দিক থেকেই অধিকতর যুক্তিনিষ্ঠ।
জাতিভেদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে ইতিমধ্যে সক্রিয়। কেশব ও যোগ্য সঙ্গত করেছেন। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে, প্রতিবাদে জনমত গড়ে তুলেছেন কেশব চন্দ্র।এককথায় ব্যক্তি- স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনলস প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করেছেন তিনি। শুধু দেশীয় পণ্ডিতদের নয় এক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয় মিশনারীদের রেয়াত করেননি। তখন এইসব মিশনারীরা ধর্মান্তরণের লক্ষ্যে হামেশাই ভারতীয় ধর্মের গোঁড়ামি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পশ্চাৎপদতা নিয়ে প্রচার করত। আর কেশবচন্দ্র লাগাতার তাদের সঙ্গে প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে শামিল হতেন। পরাস্ত করতেন।
আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে যখন, অহংকারে ফুটছেন কেশব চন্দ্র। অসংখ্য অনুগামী তাঁর। সব সময় সপার্ষদ ঘুরে বেড়ান। অনুরাগীদের পরামর্শেই দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। সেকালের কলকাতায় হইচই পড়ে যায় এই ঘটনায়। একদিকে তথাকথিত নানা শাস্ত্রে সুশিক্ষিত তার্কিক পন্ডিত। ব্রহ্মানন্দ হিসেবে খ্যাতি ভারতজোড়া। অন্যদিকে প্রথাগত শিক্ষায় অদীক্ষিত সহজ-সরল পরমহংস ঠাকুর। তাঁরও অনুগামী ভক্ত তখন কম নয়। প্রথম সাক্ষাতেই রামকৃষ্ণের ফ্যান হয়ে যান কেশবচন্দ্র। সে ঘটনা যেমন আকর্ষণীয় তেমনি আনন্দঘন। পরে উভয়ের সম্পর্ক নিবিড় হয়।
এমনই সে সখ্য–১৮৮২ সালে স্টিমার ভাড়া করে ঠাকুরকে নৌকাবিহারে নিয়ে যাচ্ছেন কেশবচন্দ্র। আসলে নিচে অনন্ত জলরাশি আর ওপরে সুনীল আকাশকে সাক্ষী রেখে ব্রাহ্মদের সামনে শাস্ত্র আলোচনার মনোরম পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন কেশবচন্দ্র। যে ধর্ম সভার প্রধান আকর্ষণ রামকৃষ্ণ।
কিন্তু এহেন জ্ঞানতাপসেরও বিচ্যুতি ঘটেছে। পচা শামুকে কেটেছে পা। নিজের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুনীতির জন্য ধর্মচ্যুত হয়েছেন তিনি। কোচবিহারের রাজপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণকে যখন জামাতা হিসেবে বরণ করেছেন তখন তার বয়স ১৮ হয়নি। সুনীতিও ১৪ তে পা দেয়নি। এমনকি ব্রাম্ভমতে নয়, রাজপ্রাসাদে বিশুদ্ধ হিন্দু মতে সেকালের সবচেয়ে আলোচনা মুখর মেগা ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা নিয়ে নানা কটুকাটব্য শুনতে হয়েছে কেশব বাবুকে। সমাজের বাইরে। অপমানিত হতে হয়েছে প্রাসাদেও। সে দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু এর সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হল–ব্রাহ্মসমাজে দেখা দিল ফাটল। শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে উঠে এল নতুন এক দল ব্রহ্মোপাসক — সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নাম নিয়ে।