অশ্লেষা চৌধুরী: পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের দাবীকে সামনে রেখে ২০০৭ সালের ৭ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। গত ১৩ বছর ধরে এই দাবীতেই অনড় রয়েছেন বিমল গুরুংরা। কিন্তু বুধবার রোশন গিরির কথায় কেমন যেন অন্যরকম সুর শোনা গেল। রোশন বলেছেন, আলাদা রাজ্য না দিক, অন্তত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কথা তো বলতে পারত বিজেপি। কিন্তু তা না করে ১২ বছর ধরে আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে। গোটা পাহাড়ের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে। তাই আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড় সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেবেন বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তাই আমরা আগামীতে মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখেই পাহাড় সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এগোব। পাশাপাশি রোশন এও দাবী করেন, পাহাড়ের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এখানকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবীতে যেভাবে দিল্লিতে গিয়ে পড়ে রয়েছে তা ভিত্তিহীন।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্র এবং রাজ্যের উদ্যোগে পাহাড় সমস্যার সমাধান করা নিয়ে কখনও সচিব পর্যায়ে আবার কখনও রাজনৈতিকস্তরে বেশ কয়েকটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু গোর্খাল্যান্ডের দাবী কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই সরাসরি মেনে নেয়নি। ২০১১ সালে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যস্থতায় পাহাড়ের আন্দোলনকে থামাতে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) চুক্তি হয়েছিল। মোর্চা জিটিএ নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের দাবী থেকে সরে আসেনি। জিটিএ চুক্তিতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের দাবীকে জিইয়ে রেখেই জিটিএ চুক্তি সই হচ্ছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য কেন এই স্বীকারোক্তি দিয়ে জিটিএ চুক্তি করল তা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪ সালে মোর্চারই প্রথম সারির নেতা তথা কালিম্পংয়ের বিধায়ক ডঃ হরকাবাহাদুর ছেত্রী মোর্চায় থেকেও গোর্খাল্যান্ডের বদলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেই সময়ই তিনি কালিম্পংকে পৃথক জেলা করার দাবীও তোলেন। বিমল গুরুং, রোশন গিরিরা সেই সময় ডঃ হরকাবাহাদুর ছেত্রীর মন্তব্যকে একান্তই ব্যক্তিগত বলে জানিয়েছিলেন। বিমলদের বক্তব্য ছিল, গোর্খাল্যান্ডই পাহাড় সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান। এই দাবী নিয়ে বিমলরা পরবর্তী সময়ে লড়েছেন।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুন মাসে এই দাবীকে সামনে রেখেই পাহাড় জুড়ে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেন বিমল গুরুংরা। বিভিন্ন মামলা, লুকআউট নোটিশে জড়িয়ে তাঁরা তিন বছরেরও বেশি সময় দিল্লিতে বিজেপির আশ্রয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, বিজেপি সাড়ে তিন বছরে কোনও দাবী নিয়ে আলোচনাই শুরু করেনি। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে ঘাসফুল শিবিরে নাম লিখিয়েছেন বিমলরা। এর পরেও বিমল বারবার বিভিন্ন জনসভা, সাংবাদিক বৈঠকে বলছেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবী থেকে আমরা সরিনি। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যের দায়িত্ব নেবেন। ২০২৪ সালে কেন্দ্রে যে সরকার আসবে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই সেই সরকারের কাছে দাবী আদায়ের জন্য ঝাঁপাব। এমনকি গত রবিবার দার্জিলিংয়ে চকবাজার মোটরস্ট্যান্ডের জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিমল একই কথা বলেছেন।
কিন্তু বুধবার দার্জিলিংয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠকে রোশন বলেছেন, ‘আমরা বিজেপিকে বলেছিলাম গোর্খাল্যান্ড না হোক, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (ইউটি) দেওয়া হোক। কিন্তু আমাদের সেই কথাতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিজেপি শুধু দলকে প্রসারিত করছে, দলের পরিধি বাড়াচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ের উন্নয়নে এবং সেখানকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নে বিজেপির কোনও ভূমিকা বা সদিচ্ছা নেই। তাই পাহাড়ের অন্য যে দলগুলি এখন এখানকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য দিল্লিতে গিয়ে দরবার করছে, সবই বেকার হচ্ছে। এসব আমরা দীর্ঘদিন করে এসেছি।‘
স্বাভাবিক ভাবেই রোশনের এই মন্তব্যে অন্যরকম ইঙ্গিত রয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠছে, তবে গোর্খাল্যান্ডের দাবী থেকে কী সরছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা?