✍️কলমে: অরূপম মাইতি
( পর্ব–১২)
মজফ্ফরপুরে বসে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কলকাতায় ফিরে জগদীশচন্দ্র বোসকে সে লেখা পড়ে শোনালেন। কবিগুরুর স্বদেশ ভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনা সম্বন্ধে আরও কিছু ব্যক্তি অবহিত হয়েছিলেন। ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন কবিগুরুর এই প্রবন্ধটি পাঠের ব্যবস্থা করেন।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে বলেছেন, চৈতন্য লাইব্রেরীতে এই প্রবন্ধ পাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ সেখানে উপস্থিত হয়। তবে তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয় এবং কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি, ইঁটপাটকেল ছোঁড়া ইত্যাদি কোন কিছু বাদ যায়নি। বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতার শেষে, স্বদেশ-পুজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন। কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে সেদিন চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।
যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধে কিছু বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছিল। সেদিন রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ ছিলেন। গায়ে জ্বর ছিল। একটানা বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসে প্রবন্ধ পাঠ করেন।
প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মত পোষণ করেছিলেন, রাজনীতি আর পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতিতে একটি নতুন বাঁক পরিবর্তন ঘটছে। বলেছিলেন, “দেশ যখন একদা জাগ্রত হইয়া ‘কনষ্টিটিউশনাল অ্যাজিটেশনে’র রেখা ধরিয়া রাজ্যেশ্বরের দ্বারের মুখে ছুটিয়াছিল, তখন সমস্ত শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিবেগ তাহার মধ্যে ছিল। আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে সেই স্রোতের পথ বাঁক লইবার উপক্রম করিতেছে।…যাঁহারা সাধনা দ্বারা, তপস্যা দ্বারা, ধীশক্তি দ্বারা ইংরেজ-শিক্ষিত সমাজের চিত্তকে স্বদেশের কার্যে চালিত করিয়াছেন, স্বদেশের কার্যে একাগ্র করিবার আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আমি ভক্তির সহিত নমস্কার করি। তাঁহারা যে পথে গিয়াছিলেন সে পথে যাত্রা যে ব্যর্থ হইয়াছে, এ আমি কখনোই বলিব না। তখন সমস্ত দেশের ঐক্যের মুখ রাজদ্বারেই ছিল।…এখন সে চিরন্তন সমুদ্রের আহ্বান শুনিয়াছে—এখন সে আত্মশক্তি আত্মচেষ্টার পথে সার্থকতা লাভের দিকে অনিবার্যবেগে চলিবে, কোনো-একটা বিশেষ মুষ্টি-ভিক্ষা বা প্রাসাদ-লাভের দিকে নহে। এই যে পথের দিক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিতেছে ইহা কোনো ব্যক্তি বিশেষের কৃতকর্ম নহে, যে চিত্তস্রোত প্রথমে এক দিকে পথ লইয়াছিল ইহা তাহারই কাজ, ইহা নূতন স্রোত নহে।
সভাভঙ্গের আগে আবেগাপ্লুত রবীন্দ্রনাথ শারীরিক অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরও কিছু বলেছিলেন। তা ছিল তাঁর লিখিত বক্তব্যের বাইরে। বলেছিলেন, “আজ সমবেত ব্যক্তিদেরকে সাহিত্যরস দেওয়ার জন্য আমি দাঁড়াই নাই। শুধু উদ্দীপনায় কোনো কাজই হয় না; আগুন জ্বালাইতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িও চড়াইতে হইবে।..আমরা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষুদ্রভাবে দেশের জন্য কাজ করিতে পারি। আমার প্রস্তাব—প্রত্যেকে নিজেদের গৃহে স্বদেশের জন্য যদি প্রত্যহ কিছু উৎসর্গ করিয়া রাখেন তবে ভবিষ্যতে সেই সঞ্চয় কাজে লাগিবে। তাহা ছাড়া উহা আমাদের একটা চেতনা প্রবুদ্ধ করিয়া রাখিবে। …আমাদের স্বদেশ ভক্তিও যেন সেইরূপ কোনো সভা-সমিতির তাগিদের প্রতীক্ষা না করিয়া নীরবে আপন কার্য সমাপন করে। স্বদেশের কাজ যেন বৃহৎ বাহ্য অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।“
সেদিন চৈতন্য লাইব্রেরিতে প্রবন্ধ পাঠ করে গুরুদেব ক্ষান্ত ছিলেন না। কলকাতা শহরের বিদ্বজ্জনদের কাছে, প্রবন্ধে লিখিত অন্তর্নিহিত বার্তা নিয়ে আলোচনা করতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন। ২৯ জুলাই সকাল সন্ধ্যায় সুকিয়া স্ট্রিটে দুই বার, ৩০ জুলাই বসুপাড়ায় সিস্টার নিবেদিতার কাছে, ১লা আগস্ট নারকেলডাঙায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, ২রা আগস্ট শ্যামবাজার ও কর্ণওয়ালিস স্টিটে, ৪-৫ আগস্ট পার্শিবাগানে, ৬ই আগস্ট আবার কর্ণওয়ালিস স্টিটে, এই ভাবে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গুরুদেব ছুটে বেড়িয়েছেন বক্তব্য প্রচারের উদ্দেশ্যে। কবিগুরুর তখম একটাই উদ্দেশ্য, যে ভাবেই হোক গঠন করতে হবে স্বদেশী সমাজ। এর বাইরেও জোড়াসাঁকোর ঠাকরবাড়িতে প্রতি দিন আসাযাওয়া ছিল একাধিক মানুষজনের। তাঁদের সঙ্গে গুরুদেব তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে বিশদে কথা বলেছেন। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে একটি চিঠিতে জানিয়েওছিলেন, একটি বিশুদ্ধ স্বদেশী সমাজ গঠনের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
(ক্রমশঃ)