Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ২৪ ॥ চিন্ময়...

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২৪ ॥ চিন্ময় দাশ

   জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ২৪

                                       চিন্ময় দাশ 

রঘুনাথ মন্দির– আলংগিরি (এগরা– ১) 
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের রাজস্ব সচিব টোডর মল্ল বাংলাকে কয়েকটি সরকারে বিভক্ত করেছিলেন। বাংলার নাজিম আজিম ওসমানের পর, মুর্শিদ কুলি খাঁ শাসক হয়ে, সরকারগুলিকে ভেঙে কয়েকটি চাকলা গঠন করেন। প্রত্যেক চাকলায় একজন ফৌজদার, তাদের অধীনে কোতোয়াল এবং থানাদাররা নিযুক্ত হয়েছিল। সেই সময় ফৌজদারি, কাজী, দেওয়ানী এবং নিয়ামত — ৪ প্রকার আদালতও প্রচলন করেছিলেন মুর্শিদ কুলী খাঁ।
জনৈক কুঙারী চরণ দাস এবং তাঁর পুত্র ভিখারি চরণ মুর্শিবাদের একটি আদালতে ওকালতি করতেন। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণের কুরুলচৌর পরগণার আলংগিরি গ্রামে নিজের স্থায়ী বসত গড়ে তোলেন কুঙারী চরণ।

সেসময় শ্রীপাট গোপীবল্লভপুরের শ্যামানন্দ প্রভু এবং রসিকানন্দ– দুই গোস্বামীর প্রচারে সমগ্র মেদিনীপুর জেলা বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল স্রোতে প্লাবিত। জেলার সমস্ত ধনী আর বনেদি পরিবারেই রাধাকৃষ্ণ এবং বিষ্ণু পূজার প্রচলন হয়েছে। আলংগিরির দুই পিতা-পুত্রও তাতে প্রভাবিত হন। ছোট একটি মন্দির গড়ে রঘুনাথজীউ এবং বালগোবিন্দ জীউর বিগ্রহ স্থাপন করে সেবাপূজার প্রচলন করেন। বাংলা ১১৯০ সনে পরিবারের পক্ষ থেকে সেবাপূজার জন্য পৌনে দু’শ বিঘা সম্পত্তি দান করা হয় দেবতার নামে। এর তিন দশক পর, বাংলা ১২১৯ সনে (ইং ১৮১২ সল্) বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। ভিখারি চরণের পৌত্র মদন মোহন-এর পুত্র ছিলেন তুলসীরাম দাস। মহাপ্রাণ এই ধার্মিক পুরুষ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
তুলসীরামের হাতে মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে একটি মর্মস্পর্শী কাহিনী শোনা যায়। মন্দির নির্মাণের জন্য, একজন সুদক্ষ সূত্রধর পেতে বহু অনুসন্ধান করেছিলেন তুলসীরাম। শোনা যায়, শিল্পী তাঁকে আতপ চালের গুঁড়ি দিয়ে মন্দিরের তিনটি আদল এঁকে দেখিয়েছিলেন। সেরা নকশাটিই বেছেছিলেন তুলসীরাম । এই নকশায় মন্দির গড়ে তোলা তাঁর সাধ্যে কুলোবে না– এই বলে বার বার তাঁকে সাবধান করেছিলেন সূত্রধর। কিন্তু পছন্দের ছবিটিতেই অবিচল ছিলেন তিনি।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এর পর মন্দির নির্মাণ যত এগিয়েছে, অর্থের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তুলসীরাম। মন্দির নির্মাণ শেষ হয়নি তখনও, তুলসীরাম একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। স্থাবর-অস্থাবর, এমনকি স্ত্রীর অলংকারও কিছু থাকলো না একসময়। তখন হাতের শেষ শাঁখাটিও খুলে দিতে বললেন পত্নীকে। পত্নী কুন্ঠিত হলে, একগাছি লাল সুতো স্ত্রীর হাতে জড়িয়ে, শেষ এয়োতি-চিহ্নটুকুও খুলে নিতে হয়েছিল তুলসীরামকে। কী গভীর ভগবৎপ্রেম, ত্যাগ আর নিষ্ঠা দিয়ে এই দেবালয়ের প্রতিটি ইট গাঁথা হয়ে আছে, এই কাহিনী না জানা হলে, তার সন্ধান পাওয়া যায় না।


ছান্দোগ্য উপনিষদে সাংখ্যায়ন বলেছেন– ” যথা হি বিষ্ণু শালগ্রামো: “।  পদ্মপুরাণ-এ ১১শ অধ্যায়ের উল্লেখ– ” গন্ডক্যামেকদেশেতু শালগ্রাম স্থলং মহৎ। পাষাণস্তরভবং যত্তৎ শালগ্রামমিতি স্থিতিম।। ”  এখানে মন্দিরে এমনই একটি শালগ্রাম শিলাই প্রতিষ্ঠিত। তিনিই মন্দিরের মূল এবং মুখ্য দেবতা। শালগ্রামের মধ্যে ১৮টি শিলা মুখ্য। লক্ষ্মীনারায়ণ, লক্ষ্মীজনার্দন -এর পর, ৩য় শিলার নাম– ‘ রঘুনাথ ‘। এই শিলাটিই এখানে পূজিত হন। তাঁর নামেই মন্দিরের নাম– রঘুনাথ মন্দির।
নিত্যপূজায় ন্যূনতম পঞ্চ-ব্যঞ্জন ও পায়সান্ন সহ অন্নভোগ হয় দেবতার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বৈষ্ণবদের নামগানের আসর বসে। এর সাথে আছে বারো মাসে তেরো পার্বণ। জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, গিরিগোবর্ধন পূজা, নন্দ-উৎসব, পুষ্যাভিষেক, মকর ইত্যাদির সাথে বড় আকারের পূজা হল– ১৩ দিনের ঝুলন পূর্ণিমা, ৩ দিনের রাস উৎসব। আর আছে– রাধাষ্টমীর ৩ দিন পর, বামন দ্বাদশী এবং পৌষের শুক্ল পক্ষে ওড়ন ষষ্ঠী। উৎসবের যেমন শেষ নাই, যাত্রী এবং ভক্ত আনাগোনারও শেষ নাই এই মন্দিরে। যাত্রীদের মধ্যে থাকেন কাছের দূরের পুরাপ্রেমীরাও। থাকবারই কথা। মেদিনীপুর জেলার সবার সেরা অলংকৃত মন্দির বলা যায় এটিকে।

দেওয়ালগুলি টেরাকোটা ফলক দিয়ে মোড়া। ফলকগুলির যেমন সূক্ষ্ম কারুকাজ, তেমনই বিষয় বিন্যাস। শিল্পকর্ম অতি উন্নত মানের।
টেরাকোটা ফলকগুলির মোটিফ মুখ্যত শ্রীমদ্ভাগবত এবং রামায়ন কাহিনী নির্ভর। সামাজিক বিষয় নির্ভর কিছু ফলকও দেখা যায়। রামায়ন থেকে আছে– সুর্পণখার নাসিকা ছেদন, স্বর্ণমৃগ, সীতা হরণ, জটায়ুর যুদ্ধ, রাম-রাবনের যুদ্ধ, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, রাবণের কাটা মুন্ড কোলে মন্দোদরীর বিলাপ– অজস্র ফলক।
কৃষ্ণকথা রূপায়িত হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবত থেকে। কৃষ্ণের জীবনে ঘটনার ঘনঘটা। তারই কিছু রূপায়িত হয়েছে এখানে– তৃণাসুর – বকাসুর – বেণুকাসুর – কংস – পুতনা রাক্ষসী বধ, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ, কৃষ্ণের গোষ্ঠবিহার, ননীচোর বালক কৃষ্ণকে জননী যশোদার রজ্জু দিয়ে বন্ধন, গোপিনীদের পার্বতী-পূজা, গিরি গোবর্ধন ধারণ ইত্যাদি।
বিবিধ বিষয়েও নানা ফলক– দশভুজা দূর্গা, চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী, গনেশ-জননী, চতুর্ভুজ কালী, ধেনুচারনা, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ইত্যাদি।দ্বারপাল, বাদক-বাদীকা মূর্তি অনেকগুলি।

কয়েকটি মিথুন ফলকও আছে। আছে কয়েকটি নারী মূর্তিও– দ্বারবর্তিনী এবং বাতায়নবর্তিনীর জননী মূর্তি, লোলচর্ম বৃদ্ধার মূর্তি উল্লেখ করবার মত। সূর্যদেবের মুন্ডমূর্তি, ব্যাদিত-বদন দুটি সিংহমূর্তি– কত কিছুই যে রচিত হয়েছে এই মন্দিরে, তার লেখা জোখা নাই।
আর আছে দুটি মানব-মানবী মূর্তি– একটি হল সেই সাধ্বী রমণীর– যিনি হাসিমুখে নিজের হাতের শঙ্খ-বলয় খুলে দিয়েছিলেন স্বামীর হাতে। দ্বিতীয় মূর্তিটি মন্দির প্রতিষ্ঠাতা তুলসীরাম দাসের। যিনি অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী এই মন্দিরটি গড়েছিলেন নিজের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত কিছু উজাড় করে, একেবারে নিঃস্ব হয়ে। উপবিষ্ট ভঙ্গিমার প্রমান আকারের মূর্তি দুটি বা-রিলিফ রীতিতে নির্মিত।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
সম্পূর্ণ বর্গাকার সৌধ– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৯ ফুট, উচ্চতা ৪০ ফুট। ৩ ফুট উঁচু পাদপীঠের উপর নব-রত্ন মন্দিরটি স্থাপিত। পূর্বমুখী এই মন্দির ইটের তৈরী। চারদিক জুড়ে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথ। গর্ভগৃহের চার দিকেই চারটি আয়তাকার অলিন্দ। পশ্চিমে কোন দ্বার নাই, তিনটি প্রতিকৃতি দ্বার রচিত আছে। বাকি তিনদিকে খিলান-রীতির তিনটি করে দ্বারপথ। স্তম্ভগুলি ইমারতি শ্রেণীর।
দুটি তলেই গর্ভগৃহের মাথায় চালা ছাউনি। রত্নগুলি শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। তাতে রথবিন্যাস এবং পীড় রীতির থাক ভাগ করা। একেবারে নয়ন মনোহর মন্দিরটি। একবার তাকালে,  চোখ ফেরানো যায় না। সেবাইত পরিবারের হাতে ভারী যত্নে রাখা হয়েছে দেবালয়টিকে।

মন্দিরের সামনে প্রশস্ত নাটমন্দির। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি দালান-মন্দিরে কালিকা-মঙ্গলা মাতার অধিষ্ঠান।
সেবাইতদের সতর্ক দৃষ্টি হার মানছে সমুদ্রের নোনা বাতাসের কাছে। মন্দিরে নোনা ধরা ঠেকানো যায় না। ঐতিহ্যপূর্ণ এমন একটি দেবালয় যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, কেন্দ্র ও রাজ্য দুই পুরাতত্ত্ব দপ্তরের নজর রাখা জরুরি। মন্দিরটিকে ‘ হেরিটেজ ‘ ঘোষণার কথা ভাবা দরকার প্রশাসনের।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাওয়া- আসা : খড়্গপুর-দীঘা রাস্তায় এগরা। সেখান থেকে মোহনপুর গামী পথের উপরেই আলংগিরি গ্রাম। হাওড়া-দিঘা ট্রেনের কাঁথি কিংবা রামনগর নেমেও আলংগিরি পৌঁছানো যাবে।
আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে এই গ্রামে। এছাড়া, ৩ কিমি দক্ষিণে উজিয়ে আর একটি মন্দিরময় পাঁচরোল গ্রাম।  আলংগিরি এলে, দুটি গ্রামের মন্দির-সার্কিট সফর জীবনের অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে বহুকাল।
সহযোগিতা : নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ দাস. মৃত্যুঞ্জয় দাস. রবীন্দ্রকৃষ্ণ দাস. মৃগাংক দাস. অসিত কুমার দাস. রঞ্জিত কুমার দাস. রাজকুমার দাস. গৌতম দে, গিরিধারী মহাপাত্র–  আলংগিরি।
জ্যোতির্ময় খাটুয়া– ট্রাভেল এক্সপি, কলকাতা।
                              প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস 

RELATED ARTICLES

Most Popular