নিজস্ব সংবাদদাতা: চন্দ্রকোনা রোড(গড়বেতা ): সকাল ৬টায় বেরুনোর জন্য ভোর চারটার সময় বিছানা ছেড়েছিল মেয়েটা! শীতের কুয়াশা ছিঁড়ে আরও চার পাঁচজন হুগলির ব্যান্ডেল থেকে রওনা দিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোডের উদ্দেশ্যে। গুগুল ম্যাপ দেখেই ঠিক করে নিয়েছিল রুটম্যাপ, হুগলি থেকে আরামবাগ হয়ে রামজীবনপুর তারপর ক্ষীরপাই চন্দ্রকোনা টাউন হয়ে চন্দ্রকোনা রোড। তারমধ্যে সে একাই মেয়ে, পারমিতা দত্তগুপ্ত। নিজের স্কুটি চালিয়েই চলে এসেছে কমরেডদের সাথে প্রিয় কমরেডকে দেখতে। যে কমরেডের নাম সুশান্ত ঘোষ আর যাকে দেখতে রবিবার হুগলির পাশাপাশি বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম মায় দুর্গাপুর থেকেও কমরেডরা এসেছেন চন্দ্রকোনা রোডে।
পারমিতা নিজেও লালে লাল। পরনে লাল সাদা শাড়ি আর নিজের স্কুটির সামনে একটা মস্ত লালপতাকা, কাস্তে হাতুড়ি খচিত। পথশ্রমের ক্লান্তি নেই এত টুকু। গাড়িতে বসেই পারমিতা জানান, ‘কাল সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি কেবলই অপেক্ষা করেছি কখন ভোর হবে আর বেরিয়ে পড়ব আমরা। মাঝে মধ্যে ভয় হচ্ছিল স্কুটিটা যদি রাস্তায় বিগড়ে যায়! কিন্তু না, শেষ অবধি ঠিকঠাকই সার্ভিস দিয়েছে ওটা। রামজীবনপুর অবধি প্রথম ১০০ কিলোমিটার প্রায় ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়েছি ৫০ থেকে ৬০কিলোমিটার। তারপর একসময় রাস্তায় ভিড় বেড়েছে। ক্ষীরপাইয়ের পর তো লালপতাকার বাইক,স্কুটি, ছোট চারচাকার গাড়ি দখল নিয়েছে। গোটা রাস্তা জুড়েই চলেছে একটা লালসমুদ্রের ঢেউ। এত ভাল লাগছিল যে মনে হচ্ছিল লোহিত সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাচ্ছি আমরা।”
হুগলির আরামবাগ থেকে এসেছেন সুবীর ঘোষ আর বাঁকুড়া থেকে নিল্টু ঘোষ। ঝাড়গ্রাম জেলার লোধাশুলি থেকে তপন কান্তি মাহাত। সোশ্যাল মিডিয়ায় গত ১৫দিন ধরে সুশান্ত ঘোষকে নিয়ে তোলপাড় করেছেন এঁরা। ঘরের ছেলের ঘরে ফেরা দেখার জন্য চন্দ্রকোনা রোডে যেন উঠে এসেছে একটা গোটা বাংলাই। তপন কান্তি মাহাত জানালেন, “এতদিন শেয়ালের দল বাঘ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার জেলায় প্রবেশ করতেই শেয়ালরা সব গর্তে ঢুকে যাবে।” সুবীর ঘোষ জানিয়েছেন, ‘মানুষের কী পরিমাণ ভালবাসা কমরেড সুশান্ত ঘোষ আর লালঝান্ডার প্রতি রয়েছে আজ এই চন্দ্রকোনা রোডের জমায়েত প্রমান করে দিয়েছে। কাউকে মাইক প্রচার করে ডাকতে হয়নি আর ধরে বেঁধে আনতে হয়নি। একেকটা মানুষের নিজের ইচ্ছাই আজ সমবেত ইচ্ছায় পরিণত হয়েছে। সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কমরেড সুশান্ত ঘোষ ঘরে ফিরেছেন।
উল্লেখ্য বেনাচাপড়া আর দাসেরবাঁধ দুটি মামলায় আটবছর আগে জামিন পেয়েও নিজের ঘরে ফিরতে পারেননি কারন রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বারংবার আবেদন জানিয়ে এসেছে যে সুশান্ত ঘোষ এখন বিধায়ক না হলেও এলাকায় তাঁর ব্যাপক প্রভাব। আর সেই কারণে তিনি মামলাকে প্রভাবিত করতে পারেন। সুশান্ত ঘোষের নবশীতিপর মা এবং স্ত্রী দুজনেই অসুস্থ জানার পরও রাজ্য সরকার তাঁর জেলায় ফেরা আটকাতে মরিয়া ছিল কিন্তু শেষ অবধি গত ১৫দিন আগে সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। এরপরই রবিবার নিজের বাড়ি চন্দ্রকোনা রোডে প্রবেশ করেন ঘোষ। হাজার হাজারে মানুষ তাই ৯বছর পরে তাঁকে দেখতে ভিড় জমান।
পারমিতা বলেন, ‘শুধু কমরেড সুশান্ত ঘোষ নন পাশাপাশি আজ চন্দ্রকোনা রোডের বাম তীর্থ যেন দর্শন করলাম আমরা। আমাদের সমস্ত পথশ্রম লাঘব হয়ে গেছে এত মানুষের মধ্যে এসে। আমার জীবনে এই অভিজ্ঞতা এমনই আনন্দের যে আমি একে কোনও দিনও ভুলবনা। আমি কমরেড সুশান্ত ঘোষের পাশাপাশি এখানে সমবেত সমস্ত মানুষকেই আমার লাল সেলাম জানাই।” ব্যান্ডেল থেকে চন্দ্রকোনা রোড ১৪৮কিলোমিটার, স্কুটিতে সময় লেগেছে প্রায় ৫ ঘন্টা। ফের ৫ ঘন্টার পথ ফিরতে হবে পারমিতাদের। সূর্য ডোবার আগেই রওনা দেয় তাঁরা।