জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২৫
চিন্ময় দাশ
দক্ষিণা কালী মন্দির, মালঞ্চ (খড়গপুর শহর )
খড়গপুর-এর পরিচয় তার রেলস্টেশন-এর কারণে। দেড়শ’ বছরও হয়নি সেই পরিচিতির আয়ু। তবে খড়গপুর নামের উৎপত্তি তারও বহু বছর আগে। সেটি হয়েছে খড়্গেশ্বর নামের শিব থেকে। এই নগরীর ইন্দা মহল্লাতে সেই শিবের অধিষ্ঠান।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ইন্দা মহল্লার উঁচু দমদমার উপর রেল যখন পাতা হোল, তারও দেড়শ’ আগে খড়্গপুরের মালঞ্চ এলাকায় একটি কালী মন্দির গড়েছিলেন এক জমিদার। এঁর পূর্বপুরুষদের বাস ছিল হাওড়া জেলা বালি। তবে আদিতে এঁরা এসেছিলেন কান্যকুব্জ থেকে। এই বংশের জনৈক মকরন্দ ঘোষ বালি থেকে খড়গপুরের জকপুর গ্রামে এসে নতুন করে জমিদারি প্রতিষ্ঠা এবং বসবাস শুরু করেছিলেন।
মকরন্দের পৌত্র সুবুদ্ধির আমলে একটি ঘটনা ঘটে। একবার রাজস্ব বকেয়ার জন্য মেদিনীপুরের কয়েকজন জমিদার নবাব দরবারে আটক হলে, সুবুদ্ধি নিজে অর্থ সংগ্ৰহ করে, জমিদারদের মুক্ত করিয়েছিলেন।
এরপর নবাবের এত্তেলা পান সুবুদ্ধি। দরবারে হাজির হলে, সন্তুষ্ট নবাব তাঁকে জলেশ্বর পরগনার দায়িত্ব এবং রায় উপাধি আর মহাশয় খেতাব দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। অন্য জমিদারদের সংকটে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন– সেকারনে মহাশয় খেতাব। সেদিন থেকে এই বংশ রায় পদবি নিয়ে, “ মহাশয় বংশ “ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
আকবরের রাজস্ব সচিব টোডর মল্ল যখন জলেশ্বরকে জেলা হিসাবে গঠন এবং তার শাসক হিসাবে ‘ সদর কানুনগো ‘ পদ তৈরী করেন, সুবুদ্ধি তখন সেই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ‘ স্টার্লিং’স হিস্টোরী ‘ থেকে জানা যায়, সদর কানুনগোরা তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মত ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করতেন।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
শেখ সুজা সুলতান হয়ে, সরকারগুলি পুণর্গঠন করেন। পরে মুর্শিদ কুলী খাঁ বাংলার নবাব হয়ে, সরকারগুলি ভেঙে কয়েকটি চাকলা গড়েছিলেন। সেসময় রায় মহাশয় বংশের তিন জমিদারকে তিন চাকলার কানুনগো নিয়োগ করা হয়। মেদিনীপুরে রাজনারায়ণ রায় মহাশয়, হিজলিতে দেবনারায়ন রায় মহাশয় এবং জলেশ্বরে জয়নারায়ণ রায় মহাশয়।
দেখা যায়, রায় মহাশয় বংশের যিনি যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানে নিজের দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। জকপুরে নিজেদের রাজধানীতে, মেদিনীপুর শহরের বাসভুমিতে, ওডিশার জলেশ্বর ও দেহুড়দায়– সর্বত্র।
এই বংশের মাধবরাম রায়ের পুত্র ছিলেন জনৈক গোবিন্দরাম রায়। তিনি ধারেন্দা পরগণার কয়েকটি মৌজা কিনে নিজের একটি জমিদারি গড়েছিলেন। গোবিন্দরাম সেসময় জকপুর থেকে খড়গপুরের মালঞ্চ চলে আসেন। তিনিই এখানে কালিমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
দেবীর কোনও মূর্তি নাই এখানে। পঞ্চমুণ্ডী আসন, তাতে একটি ঘটের উপর মোমের প্রলেপ দেওয়া একটি মুন্ডমূর্তি স্থাপিত।
কীর্তিই রাজার পরিচয়। মন্দিরে সেই পরিচয় রেখেছেন গোবিন্দরাম। উঁচু ভিতের উপর আট-চালা রীতির মন্দির। কিন্তু আয়তনে বেশ বড়– দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট, প্রস্থ ২৩ ফুট, মাথার উচ্চতা ৪৭ ফুট। টেরাকোটার সংক্ষিপ্ত একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে– ” শুভমস্তু শকাব্দ ১৬৩৪ “। অর্থাৎ ইং ১৭১২ সালে এটি নির্মিত। ৩০০ বছর অতিক্রম করেছে মন্দিরের আয়ু।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী মন্দিরে প্রদক্ষিণ পথটি প্রশস্ত। পরে, প্রথমে একটি অলিন্দ। তাতে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। গর্ভগৃহে দ্বারপথ একটিই। অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহে প্রথমে দুদিকে দুটি বড় খিলানের উপর ক্রমান্বয়ে ভল্ট নির্মাণ করে সিলিং নির্মিত হয়েছে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
টেরাকোটা ফলকে সাজানো মন্দির এটি। একেবারে ভিত্তিবেদীর যে প্যানেল, সেখানে ফলকের মোটিফ সামাজিক বিষয়– শিকার, যুদ্ধদৃশ্য, বাইজি নাচ প্রভৃতি। খিলান ও কার্নিশের মধ্যবর্তী অংশে তিনটি প্যানেল। তাতে রামায়ন, কৃষ্ণকথা, পুরান কাহিনী ইত্যাদি রূপায়িত। রাম-রাবণের যুদ্ধ ফলকটি বেশ আকর্ষক। রাম, লক্ষ্মণ, রাবণ এবং কুম্ভকর্ণ– প্রত্যেকেই পৃথক চারটি রথে আরূঢ়। রাবণের দশানন মূর্তিটি ভারী নিপুন হাতের কাজ।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কার্নিশের নীচ বরাবর এবং দুই কোনাচের গায়ে সমান্তরাল ভাবে তিনটি সারিতে বহু দেবদেবীর ছোট আকারের মূর্তি। দুটি রাসমন্ডল চক্র আর বীণাবাদনরত গন্ধর্ব মূর্তিটি অপরূপ। এছাড়া গায়ক, সাধু, অপ্সরা, যোদ্ধা, নর্তকী মূর্তিগুলিও উল্লেখ করার মত। দুটি মিথুন মূর্তিও দেখা যায়। এককথায় সমৃদ্ধ টেরাকোটা ফলকে বিশেষ গৌরবের অধিকারী দেবালয়টি।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কিন্তু জীর্ণতা গ্রাস করছে ৩০০ বছর আয়ুর সৌধটিকে। স্থাপত্যপ্রেমী জনৈক সুভাষ চন্দ্র বসুকে দেখা যায়, বুকে করে আগলে রেখেছেন দেবালয়টিকে। সাধ্যমত চেষ্টা করছেন মন্দিরটিকে জরার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবার। কিন্তু একজনের ক্ষমতা আর কতটুকু?
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাওয়া-আসা : ৬নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের চৌরঙ্গী (মেদিনীপুর-খড়গপুর ক্রসিং) ছাড়িয়ে পশ্চিমে ঝাড়গ্রাম অভিমুখে সাহাচক স্টপেজ। সেখানে নেমে, সামান্য দক্ষিণে মন্দিরটি অবস্থিত। খড়গপুর বা গিরি ময়দান স্টেশন থেকেও মন্দিরে আসবার ছোট গাড়ি নিয়মিত যাতায়াত করে।
সমীক্ষা-সঙ্গী : শিবপ্রসাদ ঘোষ– খরিদা, খড়গপুর।
প্রচ্ছদ:রামকৃষ্ণ দাস