নরেশ জানা : কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেই হয়ত সন্তুষ্ট থাকতে হত ছেলেটাকে। আর সেটাই বা কম কিসের? পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের অজ পাড়া গাঁ থেকে কলকাতা কম কিসের? এটা পেলেই বর্তে যায় অনেকেই কিন্তু ২৮ বছরের দয়ানন্দ গরানি সেখানেই থেমে থাকার পাত্র নন। অদম্য অধ্যবসায় আর একাগ্র লক্ষ্য তাঁকে শেষ পৌঁছে দিল তাঁর স্বপ্নের দেশে যেখানে বিরাট কোহলির চেয়ে মাত্র ২২ গজ দূরে দাঁড়িয়ে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন তিনি। তাও আবার ক্রিকেটের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে।
তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার এদেশের অনেকের মতই হয়ত হয়নি কিন্তু ভারতের জার্সি পরে কোহলি ও চেতেশ্বর পুজারার পাশাপাশি ভারতীয় দলটাকে প্রতিমুহূর্তের জয়ের জন্য তাঁকে প্রস্তুত করতে হবে এটা কী কোনও সাধারণ কৃতিত্ব ? তাই খবরটা পাওয়া মাত্রই চমকে গিয়েছিলেন গরানি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট এলাকার প্রত্যন্ত তমলুক থানার জামিত্যা গ্রামের এক সাদা মাটা চাষার ছেলে তাই দুবাই থেকেই বাবাকে প্রথম ফোনটা করেন। সংবাদদাতা পি.টি.আইকে নিজের প্রথম সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দুবাই থেকেই আবেগ মথিত গরানি জানান, “আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, বিষয়টা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল, এটা কী সত্যি? তারপর বাবাকে যখন ফোন করে জানাই তখন তিনি ‘নির্বাক’ হয়েছিলেন এবং আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।”
আগামী ১২ই নভেম্বর মাত্র ৪৮ ঘন্টা ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়া সফরে উড়ে যাবেন দয়ানন্দ।আর ঠিক তার আগেই জুটে গেল এই অভাবনীয় সুযোগটা। সেই মুহূর্তে তিনি দুবাইয়ে আইপিএলে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের সাথে কাজ করছিলেন আর কাজ শেষে তাঁর ফিরে আসার কথা ভারতে, নিজের দেশে। তখনই খবরটা এল জাতীয় দলের নিয়মিত থ্রাউনডাউন বিশেষজ্ঞ রাঘভেন্দ্র (রঘু নামে পরিচিত) COVID-19 আক্রান্ত এবং তাঁর অবস্থার অবনতি হয়েছে। এরপর নির্বাচকদের কাছে দ্বিতীয় বিকল্প ছিলনা দয়ানন্দ ঘরানি ছাড়া। আর নির্বাচিত হওয়ার পর দয়ানন্দ বলেছেন,
“সারাজীবন, আমি দেশকে সেবা করার স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং এটাই সুযোগ। আমি কখনই ভাবিনি যে এতো তাড়াতাড়ি আসবে। আইপিএলের সময় তারা অবশ্যই আমার মধ্যে কিছু দেখেছিল – এটা সত্যিই টার্নিং পয়েন্ট ছিল।” ।
এটা ঠিকই যে আইপিএল আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দান সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সম্পুর্ন নতুন চ্যালেঞ্জ কিন্তু এঁদো গ্রামের কাদা মাড়িয়ে যে ছেলেটা ‘গ্রিন পুলিশ’ হয়ে যে কলকাতার বেপরোয়া যান শাসন করতে করতে আইপিএল অবধি পৌঁছে গেছে তার কাছে এই প্রতিকূলতাকে পরাজিত করা খুব বড় কথা কী? একটানা প্রায় তিন ঘন্টার জন্য ১৪০ কিলোমিটার গতিতে সাইড-আর্মের সাথে বোলিং করতে পারে যে ছেলেটা তার কাছে অস্ট্রেলিয়ার ঝড় নিশ্চিতভাবেই প্রতিহত হবে।
গরানি বলেন, ‘ ছোটবেলায় আমি একজন জিমন্যাস্ট ছিলাম এবং শারীরিকভাবে ফিট রাখতাম। আর ভাবতাম বাউন্সার, ইয়ার্কার এবং পুরো দৈর্ঘ্যের ডেলিভারি হোক, ব্যাটসম্যান যা খুশি করুক আমি তার জন্য প্রস্তুত।” কিন্তু সেটা ছিল একটি সাময়িক সময়ের ক্লাব ক্রিকেটারের ভাবনা, যিনি এমনকি এক সময় সাদা কোলাঘাটট থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কেনার পয়সা জোগাড় করতে পারেননি। তবে ভাবনা বদলে গেল ২০০৭ -০৮ সালে যখন অশোক দিন্ডা ও ঋদ্ধিমান সাহা কোলাঘাটে একটি টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করতে তাঁকে কিছু টিপস দিয়ে গেছিলেন।
গরানি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে জানিয়েছেন, “কোলাঘাট সিসি ৮০-র ডাঃ মলয় পাল স্যার এবং কৌশিক ভৌমিক স্যার আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। কলকাতায় খেলতে আসার অর্থ যোগাতেন তাঁরাই আর্থিক প্রয়োজনের যত্ন নিয়েছিলেন।”
কলকাতায় বারানগর স্পোর্টিং ক্লাব এবং হোয়াইট বর্ডার স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে খেলার পর ২০১৩ সালে কলকাতা পুলিশের ফার্স্ট ডিভিশনের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং ‘গ্রিন পুলিশ’ হিসাবে তাদের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। এদিকে তাঁর বয়স বাড়ছে এবং খেলোয়াড় হিসাবে ক্রিকেটের স্বর্গ সিঁড়ি যখন ক্রমশ দুরে সরে যেতে চলেছে তখনই কলকাতা পুলিশের দেবরাজ নাহাতা তাকে কিছুটা ফিটনেস প্রশিক্ষণ এবং মাসিওর কোর্স করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এরপর বেঙ্গল প্রশিক্ষক সঞ্জীব দাসের (হারু )সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং ২০১৬ সালে অন্ধ্র রঞ্জি দলে যোগ দেন, যেখানে তিনি টেস্ট খেলোয়াড় হনুমান বিহারি এবং ভারতের অনূর্ধ্ব -১৯ দলের প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি ভূঁইয়ের মুখোমুখি হয়ে থ্রো ডাউন শিল্পে নিজেকে নিয়ে চলে এলেন।
অন্ধ্র সফর কালে পাঞ্জাব কোচ মুনিশ বালির নজরে পড়ে যান দয়ানন্দ আর তিনি তাঁকে নিয়ে আসেন কিং ইলেভে জন্য, বাকিটা ইতিহাস। এখন
কেএল রাহুল, ক্রিস গেইল এবং অনিল কুম্বলেয়ের পছন্দ মতো ড্রেসিংরুম ভাগ করে নেওয়া গরানির জন্য জল ভাত। ইতিহাস পূর্ব মেদিনীপুরের জন্যও বটে। তমলুকের নেইছনপুর এক্সপ্রেস অশোক দিন্ডার পর জাতিকে আরও এক তারকা উপহার দিল পূর্ব মেদিনীপুর। পলি লালিত কালো মাটির দেশ থেকে এবার খেলোয়াড়দের জন্য এক ফিটনেস ট্রেনার পোশাকি ভাষায় যাকে বলা হয় থ্রো ডাউন বলার ও আ্যসিস্টেন্ট ম্যাসিওর।