নরেশ জানা : এতদিন যা নিরাপদ ভাবা হচ্ছিল তা আদতে মারাত্মক বিষ! চা কিংবা কফি শপে বারবার ব্যবহার করা কাপ কিংবা গ্লাস এড়ানোর জন্য আমরা জনপ্রিয় করে তুলেছি একবারের জন্য ব্যবহার করা কাগজের কাপকে অথচ এই কাগজের কাপই আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ক্যাডমিয়াম,ক্রোমিয়াম, পালাডিয়াম ইত্যাদি মারাত্মক রাসায়নিক যৌগ। হ্যাঁ এরকমটাই বলছে IIT Khargpur য়ের সাম্প্রতিকতম গবেষনা। এই গবেষণা বলছে কাগজের কাপে আমরা যে চা বা কফি জাতীয় গরমপানীয় পান করছি তা আমাদের শরীরে সংযোজিত করছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনু প্লাস্টিক কনা এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে? আইআইটির গবেষকরা বলছেন বেশিরভাগ কাগজের কাপেই ব্যবহার করা অতি সূক্ষ্ম প্লাস্টিক (পলিলিথিন)অথবা কো-পলিমার যা কিনা কাগজের অংশটিকে ভিজতে দেয়না। মাত্র ১৫মিনিট গরম জলের সংস্পর্ষে এসে তাই মিশে যাচ্ছে পানীয়র সঙ্গে এবং প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন IIT Khargpur য়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সুধা গোয়েল এবং গবেষক পড়ুয়া বেদ প্রকাশ রঞ্জন ও এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আরেক গবেষক পড়ুয়া অনুজা জোসেফ।
অতি সম্প্রতি ‘জার্নাল অফ হ্যাজার্ডস ম্যাটেরিয়ালস’ নামক একটি গবেষনাপত্রে অধ্যাপক সুধা গোয়েল বলেছেন, ” আমাদের গবেষনা বলছে ৮৫ থেকে ৯০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায় একটি ১০০মিলিলিটার চা কিংবা কফি ১৫মিনিট বাজার চলতি কাগজের কাপে থাকলে
২৫ হাজার মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক কনা উদ্গীরণ করে যা মানুষ খালি চোখে দেখতে পায়না। একজন মানুষ যিনি এই চা কফিতে সহজ অভ্যস্থ যদি প্রতিদিন তিনবার কাগজের কাপে তাঁর পছন্দের গরম পানীয় পান করেন তবে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই নিজের শরীরে ৭৫হাজার মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক কনা অনুপ্রবেশ করাচ্ছেন।”
গবেষকরা জানাচ্ছেন ২টি পদ্ধতিতে এই গবেষনা করা হয়েছে। প্রথমত: যে পদ্ধতিতে আমরা চা বা কফি পান করি সেই পদ্ধতিতে ৮৫ থেকে ৯০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রার ফুটন্ত জল কাগজের কাপের মধ্যে ১৫মিনিট রাখার পর সেই জলটিকে বিশ্লেষণ করা। এভাবে অনুপ্ল্যাস্টিক কনা ও অন্যান্য পদার্থ বেরিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায় ফুটন্ত জলে গরম কাপটিকে ডুবিয়ে তার শরীর থেকে সন্তর্পনে খুলে নেওয়া হয়েছে সেই হাইড্রোফোবিক ফিল্ম তারপর তারমধ্যে সেই ৮৫ থেকে ৯০ ডিগ্রি তাপের ফুটন্ত জল ১৫ মিনিট রেখে সেই জলের রাসায়নিক ও পদার্থগুলি পরীক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে খুলে নিয়ে আসা হাইড্রোফোবিক ফিল্মটিও পরীক্ষা করা হচ্ছে। হ্যাঁ, এই হাইড্রোফোবিক ফিল্ম থেকেই ফুটন্ত জলের সংস্পর্ষে পানীয়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, পালাডিয়াম ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ।
মজার ব্যাপার হল নমুনা হিসাবে এই কাগজের কাপ গুলি সংগ্ৰহ করা হয়েছিল খড়গপুর শহর এবং পশ্চিমবাংলার কিছু জনপ্রিয় দোকান থেকেই। “আমরা দেখেছি আমাদের সংগৃহিত কাগজের কাপগুলির বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই ভেতরের স্তর হিসাবে HDPE বা High-density polyethylene ব্যবহার করা হয়েছে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে কো-পলিমার সেলুলাস ব্যবহার হয়েছে। যদিও সব ক্ষেত্রেই গরম জলের সংস্পর্ষে আসার পর কমবেশি মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক বেরিয়ে এসেছে।” বলেন গবেষক পড়ুয়া বেদ প্রকাশ রঞ্জন। আর বিভিন্ন রকমের আয়ন ছাড়াও মিলেছে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, পালাডিয়াম। অপর গবেষক পড়ুয়া অনুজা জোসেফ বলেন, ” গরম জলের বিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসা এই প্ল্যাস্টিক স্তর বিশ্লেষণ করা হয়েছে আনবিক শক্তি ব্যবহার করে, অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র এবং তাপ সংযুক্ত করে। তারপরই এর স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।”
এই নিঃসৃত পদার্থগুলি মানব দেহের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক বলে জানিয়েছেন গবেষকরা যার প্রভাব শিশুর বিকাশ, হরমন বিকৃতি, প্রজনন এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রুনের ওপরও পড়তে পারে। অধ্যাপক গোয়েলের মতে, ‘পাশাপাশি পুষ্টি সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রজনন বিকৃতি, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা এমনকি ক্যানসারের সম্ভবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।’ চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যাডমিয়াম মানব শরীরে অনেক পরিমানে সঞ্চিত হলে কিডনি বিকল, হাড়কে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে দেয়। ক্রোমিয়াম পলমোনারি বা শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস , নাসারন্ধ্রের সমস্যার পাশাপাশি সাইনাসের ক্যানসারের কারন হতে পারে আর পালাডিয়াম আমাদের বোনম্যারো, লিভার এবং কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে যদি এসব অধিক মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করতে থাকে।
IIT Kharagpur-এর নির্দেশক (Director) অধ্যাপক বীরেন্দ্র কুমার তেওয়ারী বলেন, ভারতের অনেক জায়গাতেই কাগজের কাপ ব্যবহারে কড়াকড়ি করা হয়েছে কিন্তু এর দ্রুত বিকল্প পাওয়াটাও সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে। “আমরা খুবই দ্রুত প্ল্যাস্টিক কাপের বদলে কাগজের কাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম কারন তখন আমাদের কাছে প্রকৃতিবান্ধব একটা বিকল্প জরুরি হয়ে পড়েছিল। ভারতের কিছু ঐতিহ্যবাহী সুস্থ এবং স্থিরীকৃত জীবনযাত্রা রয়েছে এখন সেই শেকড় থেকেই আমাদের জীবনযাত্রার উপাদান খোঁজা দরকার।” তিনি বলেন মাটির পাত্র (ভাঁড়)সহজেই প্লাস্টিক এবং কাগজের কাপের বিকল্প হতে পারে। তাঁর মতে, ” যে আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলা হচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের জীবন শৈলী গ্রহনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকেরই ভাবা উচিৎ আমাদের দেশের অর্থনীতি এবং সেই নিরিখে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কী কী যুক্ত করতে পারি।”