নিজস্ব সংবাদদাতা: একটা বিজয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আরেকটা শোকের মধ্যে মেদিনীপুরবাসী। বৃহস্পতিবার সকালে বজ্রাহতের মতই আছড়ে পড়েছে দু:সংবাদ। পথ দুর্ঘটনায় নিহত সুবীর সামন্ত! মেদিনীপুর শহরের জন্য একটা নিজস্ব নিউজ চ্যানেলের জন্ম দিয়েছিলেন সুবীর। বন্ধু প্রতিম দাদা অরুন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে নয়ের দশকে কেবল লাইনের ব্যবসার পাশাপাশি মেদিনীপুর শহরের অলি গলির খবর বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিত ‘স্যাটলিঙ্ক’।
নিজের বাড়িতে বসে নিজের টিভিতে নিজেরই শহরের খবর কিংবা নিজেরই ছেলে মেয়েদের খেলার মাঠে অথবা কোনও জলসায় অনুষ্ঠান করতে দেখে আপ্লুত হতেন মেদিনীপুরবাসী, সৌজন্যে সুবীর সামন্ত। রাজনৈতিক সভা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিদ্যালয়ের বার্ষিকী অনুষ্ঠান, শহরের চুরি, ছিনতাই সন্ধ্যে কিংবা সকালে মধ্যবিত্তের সাদা কালো টিভিতে ফুটে উঠত স্যাট লিঙ্কের চ্যানেলে। এই নতুন কিছু করার তাড়নায় বেশির ভাগ সময়ই ব্যাপক লোকসানও গুনেছেন সুবীর। শহরের টিকিট বিক্রী না হওয়া জলসাতে ক্যামেরা বসিয়ে স্ত্রীর গহনাগাটি অবধি বিক্রি করছেন সুবীর কিন্তু তাতে মেদিনীপুরবাসীর বিনোদনে বাধা পড়েনি।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ফটোগ্রাফার ওয়েলফেয়ার আ্যশোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন সুবীর। বুধবার রাতে সেই সংগঠনের মিটিং করে ফিরছিলেন সুবীর। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু ছিলেন। ৬নম্বর হাওড়া-মুম্বাই জাতীয় সড়কের উলুবেড়িয়ার কাছাকছি সামনের থাকা একটি গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে সুবীরদের গাড়ি। সুবীর পেছনের আসনে ছিলেন, হয়ত সামান্য ক্ষনের জন্য চোখ লেগে গিয়েছিল তাঁর। বুকে এবং মাথায় আঘাত লাগে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেই জ্ঞান আর ফেরানো যায়নি। মধ্য রাতেই জীবনাবসান হয় ৫৫বছরের সুবীরের।
আ্যনালগ থেকে ডিজিটাল ব্যবসায় চলে এসেছিলেন তিনি।
শহরের এমনকি শহরের বাইরেও ছোট অনুষ্ঠান থেকে ভিভিআইপিদের অনুষ্ঠানের সম্প্রচার, জয়েন্ট স্ক্রিন সুবীর সামন্ত ছাড়া ভাবাই যেতনা। মেদিনীপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা IIT-Kharagpur য়ে রাষ্ট্রপতির সমাবর্তন ভাষন, চন্দ্রকোনা রোডে প্রয়াগ ফিল্ম সিটিতে শাহরুখ খানের অনুষ্ঠান! না, সুবীর ছাড়া ভাবাই যেতনা। সুবীরের হাত ধরেই অবিভক্ত মেদিনীপুর দেখেছিল ট্রলি ক্যামেরার কারসাজি। খড়গপুর, হলদিয়া, ঝাড়গ্রাম সুবীর সামন্ত ছাড়া কেউ বড় অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ঝুঁকি নিতনা। কলকাতার টালিউড ক্যামেরা মেদিনীপুরের এঁদো মাটিতে সুবীর ছাড়া বসানোর স্পর্ধা কে দেখাবে? শুধু তাই নয়। মেদিনীপুর শহরের বহু সাংবাদিক, ক্যামেরা ম্যান, ভিডিও গ্রাফারের জন্ম হয়েছে স্যাটলিঙ্কের হাত ধরেই যাঁদের কেউ কেউ আজ বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত।
প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানও গুনতে হয় সুবীরকে। মেদিনীপুর শহরের কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান চলার সময় প্রবল বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে প্যান্ডেলের একাংশ। গোটা ঘটনাই চলে যায় রাজ্য পুলিশ এবং প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। প্রায় ১ মাস ঘটনাস্থল থেকে নিজের সরঞ্জাম সরাতে পারেননি তদন্তের জন্য। কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনা বহুমূল্য সরঞ্জামের ভাড়া দিনের পর দিন গুনতে হয় তাঁকে। IIT-Kharagpur য়ের রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে আরেক বিপর্যয়। প্রবল বজ্রপাতে পুড়ে যায় সম্প্রচারের জন্য ব্যবহৃত বহু দুর্মূল্য মেশিন। এই দুই ধাক্কা সর্বশান্ত করে দেয় তাঁকে। তাই ডিজিটাল থেকে সরে ডিজিটাল প্রিন্ট ব্যবসায় সরে আসছিলেন ধিরে ধিরে। কিন্তু ভাল করে সেই ব্যবসা জমিয়ে ওঠার আগেই চলে গেলেন সুবীর।
মেদিনীপুর কলেজের গা ঘেঁষে বাবার তৈরি করা একটা ছোট্ট ছবি তোলার স্টুডিওতে কলেজের ছেলে মেয়েদের জন্য আইডেন্টি কার্ডের সাদা কালো ছবি তুলে হাত পাকিয়ে ছিলেন সুবীর। ‘উর্জ্জনা’ স্টুডিওর গলায় ঝোলানো সেই আগফা ক্যামেরা ওয়ালা বছর উনিশ কুড়ির সেই ছেলেটার মায়া ভরা হাসি এই ৫৫ বছরেও অমলিন ছিল। কোনও বেদনা কোনও লোকসান সেই হাসি কেড়ে নিতে পারেনি। সেই হাসি নিয়েই চলে গেলেন সুবীর সামন্ত। রেখে গেলেন স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলে আর অগনিত ভালবাসার মানুষকে। সুবীর চলে গেলেন কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া পুরানো দিনের আধুনিক গানের মত বারবার ফিরে আসবেন তিনি। ফিরে আসবেন প্রিয় মেদিনীপুর বাসীর মনে।