Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৩০ ...

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৩০ চিন্ময় দাশ

           

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৩০

                                  চিন্ময় দাশ

Add caption
সিংহবাহিনী মন্দির, নবগ্রাম (ঘাটাল)

আজ এই নিবন্ধে এক পত্তনিদার জমিদারবংশের কথা। কাঁসা-পিতলের শিল্প থেকে ধনবান হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। অপূর্ব শিল্পমন্ডিত করে দুটি মন্দির নির্মাণ করেছিল পরিবারটি।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
একটু পিছন ফিরে দেখা যাক।
সপ্তদশ শতকের একেবারে শেষ পর্ব তখন। দিল্লির মসনদে আওরঙ্গজেব। বাংলায় নবাব ইব্রাহিম খাঁ। এই সময়েই রূপনারায়ণের পশ্চিম তীরে এক নবীন সূর্যের উদয় হয়েছিল, তিনি শোভা সিংহ। চেতুয়া-বরদার রাজা। রাজধানি ছিল বরদাগড়।
শৌর্যে বীর্যে অমিত বিক্রমে দুঃসাহসিকতায় শোভা সিংহ হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ বাংলার এক উজ্বল নক্ষত্র। ইতিহাস তাঁকে আখ্যাত করেছিল ‘ বাংলার শিবাজী ‘ নামে।

আওরঙ্গজেবের শাসনকালের যখন একেবারে শেষ পর্ব, মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা। রাঢ় বাংলার বহু জমিদারও মুঘল আনুগত্য অস্বীকার করছেন। রাজস্ব দেওয়া বন্ধ। শোভা সিংহের্ উত্থান এই পর্বে। হুগলি দুর্গ দখল করে, বর্ধমান আক্রমন  করলেন। বর্ধমান অধিকার করলেন রাজা কৃষ্ণরামকে হত্যা করে। এর পর মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত ছুটেছিল তাঁর বিজয়রথ। এইভাবে গঙ্গা তীরের ১৮০ মাইল বিস্তৃত এক রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন তিনি।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
শোনা যায়, চরিত্রগত ভাবে ভয়ানক ক্রূর আর দুরাচারী ছিলেন এই মানুষটি। কিন্তু প্রজাদের উন্নতি, সমাজের কল্যাণ বা নিজের রাজ্যের গ্রামীণ শিল্পের বিকাশে বহু কাজ করেছিলেন শোভা। বিশেষ করে কাঁসা-পিতল আর রেশমশিল্পের উন্নতি ঘটেছিল তাঁর হাতেই। নতুন নতুন হাটের পত্তন করেছেন । নদী-খালের সংস্কার করে, জলপথে পরিবহনের উন্নতি ঘটিয়েছেন। সেই সুবাদে বিদেশিরা এসেছিল এই এলাকায়। ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান, ফরাসি আর সবশেষে ইংরেজরা এসে রেশম শিল্পে যুক্ত হয়েছিল। এক কথায়, শোভার কারণে অর্থনীতির প্রভূত বিকাশ হয়েছিল চন্দ্রকোণা, দাসপুর, ঘাটাল থানা জুড়ে।

গ্রামীণ শিল্প বিকাশের সুবাদে, বহু হস্তশিল্পীর আগমণ ঘটেছিল গোটা মহকুমা জুড়ে। স্বর্ণবণিক, গন্ধবণিক,কংসবণিক, মৃৎশিল্পী, মালাকার, কর্মকার — বহু পরিবার এসে উপস্থিত হয়েছিল মহকুমায়। তাঁদের হাতে রেশমশিল্পে অগ্রণী হয়েছিল দাসপুর, চন্দ্রকোণা, রাধানগর ইত্যাদি। কাঁসা-পিতলে খ্যাত হয়েছিল খড়ার।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
রাধানগর মৌজারই একটি অংশ হোল– নবগ্রাম। এখানে রায় পদবীর একটি কংসবণিক বংশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। কাঁসা-পিতলের ব্যবসা থেকে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছিল পরিবারটি। সেই অর্থে বড়-সড় একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা। যতদূর জানা যায়, রাধানগর, জলসরা, গনেশ বাজার, নিশ্চিন্তপুর, কাশীনগর ইত্যাদি এলাকায় জমিদারী মহাল ছিল তাঁদের। 
জমিদারী গড়বার পর, বড় মাপের দুটি মন্দিরও গড়েছিলেন জমিদাররা। মহাদেব শিব আর সিংহবাহিনী দুর্গার। সিংহবাহিনী মন্দিরে একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে– ” শকাব্দা ষোল শত নব ফাল্গুনস্য “। তা থেকে জানা যায়, ইং ১৭০৯ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। তার ঠিক ১৩ বছর আগে, ১৬৯৬ সালে, শোভা সিংহ মারা গিয়েছেন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
তার পর কেটে গিয়েছে তিন শ’ বছর।  একদিকে জমিদারী উচ্ছেদ, অন্যদিকে দীর্ঘ ৩০০ বছরের দীর্ঘ আয়ু– পরিচর্যার অভাবে, শিবের মন্দিরটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কবেই। সর্বাঙ্গে জরার আঘাত নিয়ে মুমূর্ষু হয়ে উঠেছে সিংহবাহিনীর মন্দিরটিও। সেই মন্দির নিয়েই এখানে দুটি-চারটি কথা।

ইটের তৈরী পূর্বমুখী মন্দিরটি সম্পূর্ণ চতুস্কোণ। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৪ ফুট, আর উচ্চতা ৩২ ফুট।  পঞ্চ-রত্ন রীতির এই মন্দিরে পূর্বদিক ছাড়া দক্ষিনেও একটি অলিন্দ আছে।  দু’দিকেই খিলান রীতির তিনটি দ্বারপথ। 
উপরে রত্নগুলিতে রথ বিভাজন এবং পীঢ় রীতিতে থাক কাটা। তার ফলে, মন্দিরটি ভারি সৌন্দর্য্য মন্ডিত হয়ে উঠেছিল।
তবে, এই মন্দিরের প্রকৃত সৌন্দর্য্য এর অলংকরণে। এর সামনের দেওয়ালটি সুদৃশ্য টেরাকোটা ফলক দিয়ে মোড়া। তিনটি দ্বারপথের মাথায়, কার্নিশের নিচে, দু’দিকে দুটি কোনাচের গায়ে, এমনকি স্তম্ভ বা থামের নিচের অংশেও ফলকসজ্জা করা হয়েছে।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে ফলকগুলিকে– ১. সমাজচিত্র হিসাবে–   শিকারদৃশ্য, শৃঙ্খলিত বন্দি সহ প্রহরী ইত্যাদি সামাজিক বিষয়। ২. রামায়ন কাহিনী থেকে– রাম-রাবনের যুদ্ধ, আগে-পিছে বীর যোদ্ধাদের সাথে বিভীষণ ও লক্ষ্মণ, কুম্ভকর্ণ বধ, লবকুশের যুদ্ধ ইত্যাদি। ৩. কৃষ্ণ-কথা থেকে– পুতনা বধ, ধেনুকাসুর বধ, রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি ইত্যাদি। ৪. বিবিধ বিষয় নির্ভর বহু পট আছে। তার ভিতর বিশেষ করে বলতে হয়– বীণাবাদীকা নারী, ছত্রধারী পুরুষ, জটাধারী সন্ন্যাসী, বাদকবৃন্দ ইত্যাদি।

আর একটি বিষয় বিশেষ ভাবে বলতে হয়। সামনের তিনটি দ্বারপথের খিলানগুলিকে সাজানো হয়েছে পরিপাটি করে। মুখ্য খিলানের মাথায় শঙ্খবাদিকা সহ দশটি দেবালয়। আর অন্য দুটি খিলান সাজানো হয়েছে শিবলিঙ্গ সহ বারোটি প্রতিকৃতি শিবালয় দিয়ে। এক কথায়, সমস্ত দেওয়ালটি উৎকৃষ্ট টেরাকোটা ফলকে মোড়া।

এমন একটি মন্দির বর্তমানে এতটাই জীর্ণ, গর্ভগৃহে বিগ্রহ রাখা যায়নি। সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত সৌধটি সকলের চোখের সামনে মৃত্যুর প্রহর গুনছে প্রতি দিন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
প্রাচীন মন্দির সহ, টেরাকোটা ফলক বিষয়ে যাঁরা আগ্রহী, ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার আগে, অবশ্যই একবার দেখে নিতে পারেন মন্দিরটিকে।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর কিংবা চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন থেকে ঘাটাল গামী পথে, ক্ষীরপাই আর রাধানগরের মাঝখানে, ছোট্ট স্টপেজ নবগ্রাম। সেখানে সামান্য উত্তরে রায় বাড়ি এবং তাঁদের মন্দির।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অসিত রায়, রণজিৎ রায়– নবগ্রাম।

প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস

RELATED ARTICLES

Most Popular