✍️কলমে: অরূপম মাইতি
(পর্ব–১০)
এলাহাবাদের দ্য পাইওনীয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সূত্র ধরে ১৯০৩ ডিসেম্বর ১০ তারিখে দ্য বাঙ্গালী, সম্পাদকীয় কলমে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ করে। পরে ইন্ডিয়া গেজেটে সম্পূর্ণ চিঠি প্রকাশিত হলে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। থ্রেটেন্ড পার্টিশন অব বেঙ্গল শিরোনামায় এই সময়ে প্রত্যহ দ্য বাঙ্গালী পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার খবর ছাপা হতে থাকে। ১৯০৪ ফেব্রুয়ারি ৬ তারিখে স্টার থিয়েটারে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এক বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয় যেখানে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা’ করে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধি আন্দোলনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের কোন ভূমিকা ছিল না। কোনো সভাতে তাঁকে অংশ নিতে দেখা যায় না। কোথাও কোন বক্তৃতা করেছেন তারও সংবাদ নেই। এ নিয়ে কিছু লেখেনওনি অথচ ঠাকুরবাড়ির অনেকেই এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এমন কি কার্জনের শিক্ষা সংকোচন নীতির নিয়েও রবীন্দ্রনাথ নীরবতা পালন করছেন। পরিবর্তে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁর এই নীরবতায় সে সময় অনেকে আশ্চর্য হয়েছিল।
এই সময়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। ছোটো গল্প লিখছেন। ঈশ্বর ও দেশ নিয়ে নৈবেদ্যের কবিতাগুলি লিখছেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা ওরফে বেলার বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। ১৯০২ নভেম্বর ২৩ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে মারা যান। লিখছেন নৌকাডুবি উপন্যাস।
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুর সফরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও ইউনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়ের ওপর নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন। কার্জন কিছুদিন চুপচাপ থাকলেন এবং প্রস্তাব বাতিল হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও চুপ থাকলেন। ঠিক এই সময়টাকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।‘
আসলে রবীন্দ্রনাথ এই দীর্ঘ আন্দোলন-মুখর সময়ে দূর থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়েছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব। অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে পূর্বে হয় নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সুচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে।‘
রবীন্দ্রনাথ শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি। তৎকালীন রাজনীতিকদের চরিত্র নিয়েও চরম কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, ‘রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস করা শুরু করলেও রাজশক্তির প্রতি বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করা যায়নি। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রপথে সকল অর্জনই বেরিয়ে পড়ছে—ধরে রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ছিদ্রটি হল দেশের নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে এই রাজনীতিকদের কোনো সম্পর্কই নেই।
মুষ্টিমেয় জমিদার, উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেই অন্ধের মত চলছে। ফলে দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের সংযোগ নেই।‘ তবে এ কথা অনস্বীকার্য, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে তীব্র স্বদেশপ্রেমের জোয়ার শুরু হয়েছিল, সেই অপূর্ব আন্দোলনকে রবীন্দ্রনাথ দারুণ স্বাগত জানিয়েছিলেন।
“আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।“
১৯০৪ জুন ১৬ বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।‘
(চলবে)