কেশববাড়ের পটুয়াদের দেশে
পার্থ দে
কলকাতা থেকে ঢিল ছুঁড়লে কেশববাড়! নিকোনো উঠনে নরম রোদ খায় নানা ধরনের পট চিত্র। রোদ নরম হওয়া দরকার কারন না হলে পটুয়াদের নিজের হাতে তৈরি করা গাছ গাছড়া আর প্রকৃতি থেকে সংগ্ৰহ করা ভেষজ রঙ চড়া রোদে জ্বলে যেতে পারে। অবশ্য নরম মিঠে রোদে সে রঙ পটের গায়ে একবার ধরে গেলে ১০০বছর পাকা। হাতে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় নিয়ে চলে আসা যায় কলকাতা থেকে। হয়ত আপনি দেখতে পেলেন কাঁধে একটা ঝোলা, ঝোলা থেকে একটা হাতে আঁকা কাগজের পট বের করে কারোর বাড়ির উঠানে বসে গান ধরলেন পটুয়া “শুনো শুনো সর্বজন শুনো দিয়া মন, মা মনসার কাহিনী আজ করিব বর্ণন”। সেই গান শুনতে এক সময় গৃহস্থের বাড়ির সামনে ভীড় জমে যেত। লাটাইয়ের মতো গোটানো পটটি খুললে কয়েক হাত লম্বা হয়ে যেত। পটের ছবির সঙ্গে মিল রেখে সুরেলা ছন্দে যখন পটুয়া গান গাইতেন তখন সেই পৌরাণিক কাহিণীর চরিত্রগুলি মানসচক্ষে জীবন্ত হয়ে উঠত। গানের পালা শেষ হলে মানুষজন চাল – আলু বা কিছু পয়সা দিত। গ্রামে-গঞ্জে এদৃশ্য আর চোখে পড়ে না।
একসময় লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম ছিল এই পটশিল্প। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ইউনেসকো এবং বাংলা নাটক ডট্ কম নামক সংস্থার যৌথ উদ্দোগে এই মৃতপ্রায় শিল্পটি আবার যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতে (নয়া) পটের মেলার আয়োজন করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন যায়গায় পটচিত্রের প্রদর্শনী করা হয়েছে। সেই থেকেই দিন বদলের শুরু। দলেদলে ফটোগ্রাফার থেকে পর্যটক সবাই যাচ্ছেন পিংলা। এখানকার শিল্পকর্ম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। শিল্পীরা খ্যাতি ও সমাদর পেয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।
বিশ্বের দরবারে পিংলা এক পরিচিত নাম হলেও মেদিনীপুরের অনেক পটুয়ারা এখনও প্রচারের আলোয় আসেন নি। যেমন – পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার কেশববাড়-রঘুনাথবাড়ি, হলদিয়ার চৈতণ্যপুর-দেউলপোতা, তমলুকের কাঁকটিয়া-কাঁকরদা-সাউতানচক, নন্দকুমারের ঠেকুয়া, চন্ডীপুরের নানকারচক-হবিচক (পিংলার মতো এখানেও গতবছর প্রথমবার পটের মেলা হয়েছিল), নন্দীগ্রামের কুমীরমারা-টাকাপুরা, পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর-চেতুয়া-বাসুদেবপুর-নাড়াজোল, ঝাড়গ্রাম জেলার ভসরাঘাট, মুরুনিয়া ইত্যাদি গ্রামের পটশিল্পী। এইরকমই একটি গ্রামের পটশিল্পীদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার এক ছোট্ট প্রয়াস।
আমার গন্তব্য ছিল পাঁশকুড়া থানার কেশববাড় গ্রাম। পিচ রাস্তা ছেড়ে গ্রামের লাল মাটির রাস্তা ধরলাম। ছোট ছোট পাড়া পেরিয়ে কিছুটা যেতেই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ চোখে পড়ল। আহা চোখটা জুড়িয়ে গেল। দুদিকে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। বর্ষাকালে এরাস্তায় চলাচল কতটা কষ্টকর সেটা দেখে অনুমান করা যায়। রাস্তা অতিক্রম করে মাঠের মাঝখান দিয়ে একটি সেচখাল বয়ে চলেছে। রাস্তার ওপর ছোট একটা পাকা পুল। পুলের বাঁধানো বেঞ্চে ছেলেদের আড্ডা চলছে। সেচখালের দুপাশে সারি সারি আকাশমনি গাছ। সামান্য দূরে রঘুনাথবাড়ি রেলস্টেশন। দূর থেকে মাঠের মাঝখান দিয়ে ট্রেন ছুটে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়বে। গ্রামের প্রবেশ পথে সরকারি বনসৃজন প্রকল্পের অধীনে রাস্তার দুপাশে নারকেল ও সুপারি গাছ লাগানো হয়েছে। এবার গ্রামে এসে পড়লাম। ছোট একটা গঞ্জ মতো এলাকা। একটা শিব মন্দির আছে। প্রতি বছর ধুমধাম করে গাজন উৎসব হয়। এই গ্রামেই প্রতি বছর দুর্গা পূজা হয়। প্রতিমার উচ্চতা হয় চল্লিশ ফুট। এখানে সপ্তাহে একদিন হাটও বসে। তাছাড়া কিছু দোকানপাটও আছে। দোকানগুলো পেরিয়ে কিছুটা যেতেই পটুয়াপাড়া। এখানে বেশ কয়েকঘর পটুয়ার বাস।
প্রবীণ পটশিল্পী রঞ্জিৎ চিত্রকর এখনও পটের ছবি আঁকেন আর মাটির প্রতিমা নির্মাণ করেন। এখন আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে পটের গান শোনাতে যান না। কারন টিভি আর মোবাইলের দৌলতে এখন আর মানুষের মধ্যে পটের গান শোনার আগ্রহ নেই। রঞ্জিৎবাবু বিভিন্ন সরকারী মেলা বা প্রদর্শনীতে চলে যান, পেয়েছেন কিছু শংসাপত্র। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়ের কাছ থেকে পট আঁকা এবং শুনে শুনে পটের গান শিখেছেন। পট ছাড়াও তিনি মাটির প্রতিমা তৈরি করেন। আমার অনুরোধে তিনি মনসামঙ্গল পালার কিছু অংশ শোনালেন। বাড়ির ছাদে বসে চাদরের ওপর রং তুলির আলপনা আঁকছিলেন শিল্পী হাসেনা চিত্রকর। জানালেন চাদরগুলো অর্ডার আছে, শান্তিনিকেতন যাবে। গাছ লাগানোর উপকারিতা নিয়ে তিনি একটি পটের গান শোনালেন। প্রবীণ মহিলা শিল্পী ছবি চিত্রকরের আঁকা কিছু পটচিত্র এবং নকশা করা তালপাতার পাখা দেখলাম। তিনি এখন সরকার থেকে প্রবীণ পটশিল্পী হিসাবে সামান্য কিছু পেনশন পান। এখানকার বাকী শিল্পীরাও শিল্পীভাতা পেয়ে থাকেন। বাড়ির ছোটদের আঁকা পটচিত্রগুলিও অসাধারন। তবে রঞ্জিৎবাবুদের গলায় আক্ষেপের সুর, এখান থেকে কাউকে এখনও বাংলার বাইরে কোন প্রদর্শনীতে সুযোগ দেওয়া হয় নি। ওই খুব বেশি হলে কোলকাতার ইকোপার্ক, দুর্গাপুর বা শান্তিনিকেতন। বিদেশ তো তাদের কাছে স্বপ্ন। পিংলার পটের মেলাতেও তারা নিজেদের সামগ্রী নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। তবে তাদের গ্রামে পিংলার মতো আসে না কোন বাইরের দর্শক, আসে না কোন বড় বড় ক্যামেরাওলা, আসে না কোন ডিজাইনার সংস্থা। তাই বড় কোন অর্ডার সরাসরি তারা পান না।
আমার লেখার মাধ্যমে তারা এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান, “আসুন আমাদের গ্রামে, দেখুন আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আশাকরি রং তুলির স্পর্শে আপনাদের মনকেও রাঙিয়ে দিতে পারবো। আমরা আমাদের সৃষ্টিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর”।
যোগাযোগ – মৃণাল চিত্রকর (9800820480)
যাতায়াত :
হাওড়া বা খড়গপুর থেকে লোকাল ট্রেনে পাঁশকুড়া স্টেশনে নেমে তমলুকগামী বাসে বিবেকানন্দ মোড় স্টপেজ, ওখান থেকে টোটোতে কেশববাড় পটুয়াপাড়া। অথবা ধর্মতলা / হাওড়া বা মেদিনীপুর থেকে হলদিয়া বা দীঘাগামী বাসে মেচেদার পরে রাধামনি হাইরোড স্টপেজে নেমে পাঁশকুড়াগামী বাসে ৮ কিমি দূরে বিবেকানন্দ মোড়।
আশেপাশে :◆ রঘুনাথবাড়ির ঐতিহাসিক রঘুনাথজীউর মন্দির। দুর্গা পূজার দশমীতে রথযাত্রা হয়।
◆ নিরিবিলি রঘুনাথবাড়ি রেলস্টেশন। প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্য আদর্শ জায়গা। শীতকালে নানাধরনের পাখি দেখা যায়।
◆ বেড়াবেড়িয়া গ্র্রামে ভারত সেবাশ্রমের মন্দির।
◆ ২ কিমি দূরে চকদুর্গাদাস গ্রাম। এটিও প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্য আদর্শ জায়গা। এখানেই “দুর্গেশগড়ের গগুপ্তধন” সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল।
◆ রাধামনির দিক থেকে যারা আসবেন, তারা রাধামনির শ্মশান কালী মাতার মন্দির দেখে নেবেন। যা মেদিনীপুরের মধ্যে উচ্চতম মন্দির।