Homeএখন খবরসঙ্গে রুকস্যাক ।। পার্থ দে

সঙ্গে রুকস্যাক ।। পার্থ দে

কর্মাটাঁড়! বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় বাড়ির খোঁজে                                 পার্থ দে

ঝাড়খণ্ডের মধুপুর ও জামতাড়ার মাঝের স্টেশন কর্মাটাঁড়। ছোট্ট একটা রেলস্টেশন। হাতে গোনা কয়েকটি ট্রেন দাঁড়ায়। ট্রেন চলে গেলে জনহীণ- নির্জন পরিবেশ। লাল মোরামের আঁকাবাঁকা গ্রাম্য মেঠো পথ। উঁচুনিচু টিলার মাঝে শাল, পলাশ ও কর্মা গাছের জঙ্গল। বেশিরভাগ সাঁওতাল জনজাতির বাস। একসময় এখানকার জল হাওয়া খুব স্বাস্থ্কর ছিল। শিমুলতলা, মধুপুর, গিড়িডির মতো এখানেও অনেক বাঙালী বসবাস করে। সালটা আনুমানিক ১৮৭৩। সাঁওতাল সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই জায়গাই পছন্দ হয়ে গেল পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। অবশ্য এর আগে তিনি দেওঘরের মনোরম পরিবেশে একটি বাগানবাড়িও পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু বাড়ির মালিক অনেক বেশি দাম চাওয়ায় কেনা হয়নি। তবে কর্মাটাঁড়ে এসে সেই দুঃখ মুছে গেছে।

আমরা সকলে জানি, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাঙালীদের কাছে তাই বীরসিংহ গ্রাম জনপ্রিয়তা লাভ করলেও, বিদ্যাসাগরের বার্ধক্যের বারণসী কর্মাটাঁড় আজও ব্রাত্য থেকে গেছে। চলুন একবার ঘুরে আসি সেই কর্মাটাঁড় থেকে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়, ‘‘বাঙালি উচ্চারণে কর্মাটা। আসল নাম কর্মাটাঁড়। অর্থাৎ কর্মা নামে এক সাঁওতাল মাঝির টাঁড়, মানে উঁচু জায়গা যা বন্যাতে কখনও ডোবে না।’কর্মাটাঁড় জায়গাটি ছিল সাঁওতাল প্রধান। তাঁদের সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর শেষ জীবনটা সেখানেই কাটাবেন বলে স্থির করেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন মোটেই সুখকর ছিল না। একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতে নাগরিক জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাসাগর গ্রামের সাংসারিক জীবনে অনেক অশান্তিতে আহত হন। পারিবারিক জীবন ও চারপাশের পৃথিবীটা যখন ভীষণ ভাবে তাঁর কাছে প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাসাগর একটু নির্জনতার সান্নিধ্যের জন্য বড়ই আকুল হয়ে উঠেছিলেন। অনেক দুঃখ অভিমান নিয়ে তিনি বীরসিংহ ছেড়ে যান।

তখন তিনি অনেক দূরে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের কর্মাটাঁড় (কারমাটারও বলে অনেকে) স্টেশনের কাছে পাঁচশো টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কেনেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই জমি তিনি বিদ্যাসাগরকে বিক্রি করে চলে যান। এখানেই একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন বিদ্যাসাগর। নাম দেন নন্দনকানন। রাতের স্কুল চালানোর জন্য মাঝখানে একটি হলঘর, একপাশে শোবার ঘর, অন্যপাশে পড়ার ঘর। তিনি গাছ লাগাতে খুব ভালবাসতেন। বাড়িতে ঢোকার ডান দিকে নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন একটি কিষাণভোগ আমগাছ। যেটি এখনও আছে এবং প্রচুর আম ফলে। বাগানের দেখভালের জন্য কালী মণ্ডল নামে এক মালীও ছিল তাঁর। কালীকে দিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে লাগিয়েছিলেন একটি ভাগলপুরি ল্যাংড়া আমগাছ। কার্মাটাঁড়ে বসেই তিনি ‘সীতার বনবাস, ‘বর্ণপরিচয়’-এর তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেছেন। এখানে তিনি তাঁর জীবনের প্রায় ১৭ বছর কাটিয়েছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁকে কলকাতায় যেতে হত। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার বাদুড় বাগানের বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

কর্মাটাঁড়ের সহজ সরল আদিবাসী মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সভ্যতার প্রান্তশায়ী আরণ্যক সাঁওতালদের সারল্য তাঁকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল। দলে দলে সাঁওতাল মানুষেরা বিদ্যাসাগরের কাছে আসতেন ভুট্টা বিক্রি করতে। আর বিদ্যাসাগর সেই ভুট্টা কিনে ঘরে রাখতেন। কাজ শেষে সাঁওতালেরা বিকেলে ঘরে ফেরার পথে খেতে চাইতেন বিদ্যাসাগরের কাছে। ওদের থেকে সকালে কিনে রাখা ভুট্টা খেতে দিতেন বিদ্যাসাগর। সাঁওতালদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরও সেই ভুট্টা পুড়িয়ে খেতেন। এলাকার গরীব মানুষদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তাঁদের কাছে জীবনদাতা ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেখানে মেথরপল্লিতে উপস্থিত থেকে তিনি নিজের হাতে কলেরা রোগীর শুশ্রূষা করেছেন। বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন তাঁদের সহজ, সরল জীবনযাত্রা। প্রতি বছর পুজোর সময়ে তিনি তাঁদের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনে আনতেন। শীতে কার্মাটাঁড়ে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। তখন মোটা চাদর কিনে গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। কখনও কলকাতা গেলে তাঁদের জন্য বিভিন্ন রকম ফল নিয়ে আসতেন। রাতের স্কুলে পড়ানোর জন্য ছাত্র জোগাড় করতেন।

ভাই শম্ভুচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘‘তিনি (বিদ্যাসাগর) প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি নিজে প্রদান করিতেন। অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণকুটিরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন। তাহাদের কুটিরে যাইলে তাহারা সমাদরপূর্বক বলিত, ‘তুই আসেছিস!’ তাহাদের কথা অগ্রজের বড় ভালো লাগিত।’শম্ভুচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘বড়লোকের বাটিতে খাওয়া অপেক্ষা এ সকল লোকের কুটিরে খাইতে আমার ভালো লাগে, ইহাদের স্বভাব ভাল, ইহারা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ইত্যাদি কারণে এখানে থাকিতে ভালোবাসি।’

কর্মাটাঁড় স্টেশনের সঙ্গে তাঁর নানান স্মৃতি জড়িত। ১৮৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় থাকাকালীন এক গাড়ি–দুর্ঘটনায় বিদ্যাসাগর পায়ে চোট পেয়েছিলেন। প্ল্যাটফর্ম নিচু ছিল বলে কর্মাটাঁড় স্টেশনে নামতে অসুবিধা হত। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেটা শুনে প্ল্যাটফর্ম উঁচু করে দেয়। সেসময় ঐ লাইনে আসানসোল থেকে মধুপুরের আগে একমাত্র কর্মাটাঁড়েরই প্ল্যাটফর্ম উঁচু ছিল। আরো একটি কাহিনী শোনা যায়, এক দিন এক যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে কুলি, কুলি বলে চেঁচাচ্ছিলেন। বিদ্যাসাগর কুলি সেজে সেই যাত্রীর মালপত্র বহন করেছিলেন। পরে সেই যাত্রী বিদ্যাসাগরের পরিচয় পেয়ে খুবই লজ্জিত হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে কর্মাটাঁড় রেল স্টেশনটির নাম হয়েছে বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি ও পরিচয় স্টেশনটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। হালে বিদ্যাসাগর স্টেশন ভরে উঠেছে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনের নানা পর্যায়ের রঙিন চিত্রে। ছবির মাধ্যমে বলা হয়েছে এই মহান মনীষীর জীবনের কাহিনি। রেলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সকলে।

শেষ দিকে বিদ্যাসাগর ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরেই নারায়ণচন্দ্র কার্মাটাঁড়ের বাড়ি ও সম্পত্তি বিক্রি করে দেন কলকাতার এক মল্লিক পরিবারের কাছে। তাঁরা বাড়িটি এমনিই ফেলে রাখেন। ১৯৩৮ সালে বিহারের প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা তৈরি করেন ‘বিহার বাঙালি সমিতি’। বিহারের বাঙালি সমিতি সেখানে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিরক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে ১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ  বিদ্যাসাগরের বাড়ি সহ তিন একর ১৯ ডেসিমেল জায়গা মল্লিক পরিবারের কাছ থেকে কিনে নেয় চব্বিশ হাজার টাকায়। ১৯৭৬ সালে সেখানে এই সমিতি বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী নামাঙ্কিত একটি মেয়েদের স্কুল ও দাতব্য হোমিয়ো চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করে। ২০০১ সালে বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হল। আলাদা করে তৈরি হল ‘ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি’। ঝাড়খণ্ড সরকারের সামাজিক নিবন্ধীকৃত আইনে ২০১৬-র অক্টোবর মাসে দুই বাঙালি সমিতির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ১১ সদস্যের ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি’। আদি ডিসপেনসারি চাপা পড়লেও হালে একটি ‘বিদ্যাসাগর হোমিও চিকিৎসালয়’চালু হয়েছে। তাছাড়া এখানে একটি মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

এখন সমিতির সদস্যরাই তত্বাবধান করছেন সবকিছু। বছরে তিনটি অনুষ্ঠান করেন ওরা। ২৯ মার্চ পালন করেন ‘গুরুদক্ষিণা দিবস’, ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন আর ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। শহর থেকে দূরে এক সহজ, সাধারণ, নির্জন, অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান করা হয় ঐ দিনগুলোতে। সারা বছর ধরে স্বল্প বেতনে একা কুম্ভের মতো বিদ্যাসাগরের বাড়ি দেখভাল করেন কেয়ারটেকার জিতেন্দর। গতবছর বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবীর দাস কর্মাটাঁড়ে এসে কর্মাটাঁড় থানা ও ব্লকের নাম তথা সমগ্র যায়গাটির নাম ‘বিদ্যাসাগর’ বলে ঘোষনা করেন।

কিভাবে যাবেন :
হাওড়া/শিয়ালদহ/কোলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেনে সরাসরি কর্মাটাঁড় (বিদ্যাসাগর) যাওয়া যায়।                                    ◆ কোথায় থাকবেন :
“নন্দন কানন”-এর নিজস্ব গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা আছে।

RELATED ARTICLES

Most Popular