নিজস্ব সংবাদদাতা: ‘ বাবার খুনিরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ সরকারি চাকরি পেয়েছে, কেউ আবার নেতা হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আমার বাবা চাকরি করতেন। রাতের বেলায় ওরা এসে ডেকে নিয়ে গেল। আর ফেরেনি। সংসারটা ভেসে গেল। বাড়িতে বিধবা মা, আইবুড়ো বোন আর কলেজ পড়ুয়া ভাই। আমার পড়া হয়নি বাবার খুনের পর সংসারের হাল ধরতে গিয়ে। আর প্রতিদিনই দেখি সেই ছেলেটা বাড়ির সামনে দিয়ে হুশ করে বাইক নিয়ে চলে যায়।ওই খুনি মাওবাদীটা আত্মসমর্পণ করে চাকরি পেয়েছে আর আমাদের জীবন জলে ভেসে গিয়েছে।” এমনই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন পুরুলিয়ার যুবক।
মঙ্গলবার মেদিনীপুর শহরের লোধা স্মৃতি ভবনে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া চার জেলার নিহত ও নিখোঁজ শতাধিক পরিবারের সদস্যরা হাজির হয়েছিলেন পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করতে। সেখানেই ঠিক হয় চার জেলাতেই বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন তাঁরা। কারন গত ১০ বছর ধরে ক্ষতিপূরণ পাননি মাওবাদীদের হাতে নিহত কিংবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া পরিবারের এই সদস্যরা। অথচ সরকারের প্যাকেজের মধ্যে ছিল আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা যেমন প্যাকেজ পাবেন ঠিক তেমনই প্যাকেজ পাবেন ভুক্তভোগী পরিবার গুলি। কিন্তু তৃনমূল সরকারের আমলে এক তরফা ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ পেয়েছে মাওবাদীরাই।
এদিন তাঁদের মধ্যে দাবি উঠেছে চাকরি বা সরকারি সাহায্য না পেলে উত্তাল হবে জঙ্গলমহাল! রাস্তা কাটা, অবরোধ ইত্যাদি যা করতে হয় তাই করা হবে। জেলাশাসক থেকে মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে জানানো হয়েছে। তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের টিমের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে কিন্তু তারপরও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই সংঘাতের পথই বেছে নিতে বাধ্য করছে সরকার। এবার রুদ্র রূপ দেখবে সরকার। এমনই হুঁশিয়ারি দিলেন মাওবাদীদের হাতে নিহত ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা।
চার জেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ মাওবাদীদের খুন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন। সেই হতভাগ্য পরিবারের সদস্যদের দাবি, ‘এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় ঘোষনা করেছিলেন, মাওবাদীদের হাতে নিহত ও ওই সময় জঙ্গলমহলের নিখোঁজ সদস্যদের পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াবেন। ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু ৯ বছর অতিক্রান্ত, এখনো পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি এই সমস্ত অসহায় পরিবার গুলির জন্য।”
মাওবাদীদের হাতে নিহত ও নিখোঁজ পরিবার যৌথ মঞ্চের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক শুভঙ্কর মণ্ডল বলেন, “ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে ।এবার বড়সড় আন্দোলন নের পথে নামছি আমরা। খুনি মাওবাদীদের চেয়েও বড় আন্দোলন দেখবে জঙ্গলমহল। প্রয়োজনে রাস্তা কাটব, অবরোধ করব।” যৌথ মঞ্চের সভাপতি তথা এই মঞ্চের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক সুব্রত আহির বলেন, ” যাঁর গেছে তাঁর তো গেছেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুন করা হয়েছে পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যকে। ফলে পরিবার গুলো ভেসে গিয়েছে। কারোর বাড়ির সদস্য খুন হয়েছেন, কারোর বাড়ির সদস্য এখনো নিখোঁজ। চাকরি, সরকারি সাহায্য দূরের কথা নিখোঁজদের পরিবার গুলি এখনো ডেটথ সার্টিফিকেটও পায়নি। চার জেলায় এখনো ১০১ জন মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছে শত শত মানুষ। মাওবাদীরা চাকরি পেয়েছে, অথচ আমাদের কিছু হয়নি। সুব্রত বলেন, আমার বাবা বাদল চন্দ্র আহির খুন হয়েছেন ২০০৯ সালের ১৭ই জুন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করে এনওসি দেওয়া হয়েছে চাকরির জন্য। এখনো কিছুই হয়নি। তাই আমরা আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে চার জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে মেদিনীপুরে বৈঠকে বসে ছিলাম।’
সংগঠনের সদস্যদের একটা অংশের বক্তব্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, তৃনমূলকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে মাওবাদীরাই। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে তৃবমূলের লোকেরাও খুনে অংশ নিয়েছে আর সারা জঙ্গলমহলে তৃণমূল বিরোধীদের খুন করে ক্ষমতায় এসেছে তারা আর সেকারনেই মাওবাদীরা পুরস্কৃত হয়েছে আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার গুলি।
“আপনি জঙ্গলমহলের তৃণমুল নেতৃত্বের দিকে তাকান দেখবেন বেশির ভাগই মাওবাদীদের ঘনিষ্ট ছিল। বাকি ছিল ছত্রধর মাহাত তাকেও রাজ্যের নেতা করে দেওয়া হয়েছে। এই খুনিরাই কী জঙ্গল মহলে শেষ কথা বলবে?” প্রশ্ন তুললেন এক নেতা।