যৌবনকাল

✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়

(পর্ব–৮)

খিলখিল হাসির সঙ্গে ভেসে আসছিল অশ্লীল সংলাপের ফুলঝুরি। এছাড়া মাতালদের বেসামাল চলাফেরা আর দালালদের আস্ফালন। ভদ্রপল্লীর খদ্দের ধরার আশায় রংচং মেখে সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে নিষিদ্ধ পল্লীর তথাকথিত নষ্ট যুবতীরা। শহর কলকাতা এই ছবি দেখছে দীর্ঘদিন ধরে। ব্রিটিশ কর্মচারীদের প্রয়োজন মেটাতে কলকাতা শহরে গজিয়ে উঠলো একাধিক পতিতালয়। পাল্লা দিয়ে এগিয়ে এলেন বিত্তশালী জমিদারের দল এবং তথাকথিত বাবু সম্প্রদায়। কলকাতার মানচিত্রে সংযোজিত হলো সোনাগাছি,রামবাগান,বা শেঠবাগানের মতো কুখ্যাত অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইস্তক উত্তর কলকাতায় জাঁকিয়ে বসলো সেই আদিম ব্যবসা।
সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে আত্মপ্রকাশ করল হাড়কাটা গলি বা তালতলার ধুকুরিয়া বাগান। কড়েয়া বা ফ্রিস্কুল স্ট্রিট। হরি-শার বাজারের উল্টোদিকে নন্দনবাগানে ইতিউতি টালির ছাউনিতে রঙিন রাতের হাতছানি। একদিকে কালীঘাটের আদিগঙ্গা বরাবর সুপ্রাচীন বেশ্যালয়। অন্যদিকে জমজমাট হয়ে ওঠা ওয়াটগঞ্জ স্ট্রিট বা মুন্সীগঞ্জ রোডের কুখ্যাত গলিঘুঁজি। পুরনো কলকাতার সেই চিত্র খুব একটা বদল হয়নি। লক্ষ্য করেছিলাম,শুধু পরিবর্তনের হাওয়ায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখনও সোনাগাছি,হাড়কাটা গলি কিংবা কালীঘাট পুরোদমে রয়েছে। বেশ্যাবৃত্তি আইনানুগ নয়। ইম্মরাল ট্রাফিক আইনে শৃঙ্খলিত। তবে তলেতলে রয়েছে আড়কাঠির বাড়বাড়ন্ত আর পুলিশের ফস্কা গেরো। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছেন সমাজসচেতন কিছু এনজিও।এখন পতিতালয় ছাড়াও কিছু ক্ষণের জন্য মহিলাসঙ্গী সহজলভ্য। ম্যাসেজ পার্লার বা হোটেল-মধুচন্দ্রিমা তো আছেই। তাছাড়া ইন্টারনেটের সুবিধে নিয়ে বেড়েছে কলগার্ল এবং অভিজাত এসকর্ট সার্ভিস।
হিন্দুসমাজ এখনও কালিকাপুরাণের দোহাই দিয়ে বিশ্বাস করেন,দুর্গাপুজোর সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। তবু আইন মোতাবেক দেহ-ব্যবসা আমাদের দেশে দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আদিম ব্যবসা পশ্চিমী দুনিয়ার মতো নিবন্ধনকৃত বৃত্তি হিসেবে এখন অবধি উন্নীত হলো না।
আমি নিজেও যৌবনকালে বন্ধুদের সঙ্গে নিছক অ্যাডভেঞ্চারের মোহে সোনাগাছির নীলকমল
বিল্ডিং -এ নন্দরানীর কোঠায় ঢুকেছি। হতভম্ব লেগেছিল ঘরের ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট,এসি আর হাল মডেলের টিভি দেখে। পানাহারে পকেট খালি হয়ে যাবার পর আমাকে গচ্ছিত রেখে সঙ্গীরা অর্থের সংস্থানে বেরিয়েছিল। সেই বন্দিদশা থেকে যে- ভাবে মুক্তি পেয়েছিলাম সেই রোমহর্ষক কাহিনি আজ নাই বা শোনালাম।
পৃথিবীর বহু বারাঙ্গনা পরিবেশে গিয়েছি।আসানসোলের কাছে নিয়ামতপুর থেকে মুম্বাই-এর গ্রান্টরোডেও। সিঙ্গাপুর,ব্যাংকক কিংবা হংকং-এ কাটিয়েছি অনেক বিনিদ্র রাত। তবে আমাকে বিষ্মিত করেছিল বাংলাদেশের খানকিপট্টি। অবশ্য বিগত দু-দশকে নারায়নগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের যৌনপল্লী উচ্ছেদ করা হয়েছে।সাম্প্রতিক ভ্রমণে চোখে পড়েনি মাদারিপুর,খুলনার ফুলতলা কিংবা টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ার রেন্ডি বসতি। অবশ্য আবাসিক হোটেলকক্ষে এই বৃত্তিতে নিয়োজিত যৌনকর্মীর অভাব নেই। বরিশালে এক বারাঙ্গনার কন্ঠে শুনেছিলাম লালন ফকিরের একটি পদ।”গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়?/লালন বলে জাত কারে কয় এ ভ্রম তো গেল না।”
ঢাকার বিত্তশালী বন্ধু সালাউদ্দিন বলেছিলেন,এখন বেশ্যালয়ের কোনও প্রয়োজন নেই। ফোন করলেই আপনার বাসায় কেউ না কেউ হাজির হয়ে যাবে। শুধু ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। তারপর রাতটা আপনার।
সালাউদ্দিনের ফোনালাপে ঘন্টাখানেকের মধ্যে এক সুন্দরীর আবির্ভাব হলো তার বারিধারার অভিজাত বাংলোয়। সালাউদ্দিন বলল,ছবি আঁকে। কবিতা লেখে। তাছাড়া একটি চ্যানেলের উপস্থাপিকা।
গেটের কাছে সালাউদ্দিনের বিএমডব্লু গাড়ি থামল।একটা অত্যন্ত দামি পারফিউমের গন্ধ মম করছিল তখন। মেয়েটির দিকে নিবিষ্টভাবে তাকালাম। তারপর থতমত খেয়ে চাপা গলায় বললাম,তুমি অন্তরা শেখ না? মনে পড়ছে, একবার এক কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলে। তোমার উপহার দেওয়া কবিতার বই এখনও আমার সংগ্রহে রয়েছে।
মেয়েটি চোখের পলক না ফেলে আমার দিকে তাকাল। গলার স্বর কাঁপাতে কাঁপাতে বলল,আমি সময় পেলে এখনও কবিতা লিখি। তবে ছবি আঁকা আর হয়ে ওঠে না।
সালাউদ্দিন বলে উঠলেন,ক্যামন সারপ্রাইজ দিলাম বলুন। এমনটা কী ভাবতে পেরেছিলেন?
সেই রাতে আমি অন্তরাকে ছুঁয়েও দেখিনি। অবশ্য সালাউদ্দিনের ব্যাপারটা আমার জানা নেই। এতটাই মদ্যপান করেছিলাম যে মনে হলো অন্তরার সুঠাম দেহটা গভীর জলের দিকে সরে যাচ্ছে ঢেউ তুলে।ডিঙি নৌকার মতো স্বচ্ছন্দ গতি। যেন চলেছে বৃহত্তর কূলকিনারাহীন অথই অন্ধকারে। সুখস্বপ্নের দিকে চোখ রেখে সে আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগল।

(চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular