ক্ষুদিরামের গুহার সন্ধানে পার্থ দে
কথায় বলে, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই।’ কাশ্মীর-সিমলা-উটি-সান্দাকফু-সিকিম নয় ঘর হতে দুইপা ফেললে আশেপাশে কত কি দেখা ও জানা যায়। আমরা পঞ্চপান্ডব বেরিয়ে পড়েছিলাম এরকম এক অজানার সন্ধানে।
বারিকুল-ঝিলিমিলি রাস্তার পাশে শাল-পলাশ-মহুয়ার জঙলে ঘেরা গ্রাম ছেঁদাপাথর। শহীদ ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত বাঁকুড়া জেলার বারিকুল থানার অন্তর্গত এই গ্রাম। বাঁকুড়ার এই অঞ্চল জল, জঙ্গল, টিলা, লাল মাটির অঙ্গরাগে ভূষিত। পূর্ণিমার রাতে জায়গাটি হয়ে ওঠে মোহময়ী।
স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসু ১৯০৮ সালে এই গ্রামেই কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন। স্থানীয় মতে, ছেঁদাপাথরের গভীর জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের গুহায় এসে তিনি কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন। সেই গুহার ভিতরে বসে তিনি বোমা বাঁধতেন এবং গোপন বৈপ্লবিক কাজকর্ম করতেন।
ফুলকুসুমা থেকে ছেঁদাপাথর যাওয়ার জঙ্গল পথটি বড়ই সুন্দর ও নির্জন। ছেন্দাপাথর হাইস্কুলের কাছেই রাস্তার ওপরে ত্রিপুরা মাহাতোর বাড়ি ও দোকান। ওনাকে বলতেই এককথায় রাজি। আমাদের একটা বাইকের পেছনে বসে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন লোকাল গাইড ত্রিপুরাবাবু। কিছুটা পিচ রাস্তা তারপর বাইক রেখে আরো কিছুটা হাঁটাপথে বনবাদাড় সরিয়ে এসে পৌঁছলাম এক পরিত্যক্ত গুহার সামনে। গাইডবাবু তার শীর্ণকায় শরীর নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লেন একটা গুহার মধ্যে। আমাদের ভেতরে ঢুকতে বললেন। কিন্তু আমাদের কারোর পক্ষে ঐভাবে গুহার মধ্যে ঢোকা সম্ভব ছিল না। তার ওপর সাপখোপ থাকতে পারে। খাদানে বৃষ্টির জল জমে নীলাভ রঙ হয়ে আছে।
গাইডবাবু জানালেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, ভারতের একটি কোম্পানী সরকারের কাছ থেকে এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চলটি কিনে নেয়। তারা ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে গুহার মধ্যে তন্নতন্ন করে খনিজ সম্পদের সন্ধান চালায়। কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যায় নি। হতাশ হয়ে তারা অন্য একটি কোম্পানিকে বিক্রি করে দেয়। সেই কোম্পানি ভাঙা পাথর বা স্টোন চিপসের ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে যায়গাটি একটি পরিত্যক্ত পাথর খাদানে পরিনত হয়েছে। বর্ষার জল জমলে লেকের মতো দেখতে লাগে।
শহীদ ক্ষুদিরামের স্মৃতিতে ২০০১ সালে রানিবাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির তরফে ছেঁদাপাথরে তৈরি করা হয় শহীদ ক্ষুদিরাম উদ্যান। সেখানেই একটি দ্বিতল পর্যটক আবাস নির্মাণ করা হয়। উদ্বোধনের পর কিছুদিন পর্যটক আবাসটি খোলা ছিল। তারপর থেকেই বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই এলাকার রাজনৈতিক পরিবেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ দেখে ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি পর্যটকরা আর জঙ্গলমুখো হয়নি। শহীদ ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত ছেঁদাপাথরেও তাই পর্যটকদের পা পড়েনি বললেই চলে। তার জেরেই উদ্বোধনের এক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক আবাসটি। পরিবেশ বদলালেও এখনও খোলেনি পর্যটক নিবাস।
উদ্যানের একদিকে রয়েছে ক্ষুদিরাম বসুর মর্মর মূর্তি। বাঁদিকে আমগাছের পাশে বাঁধানো চাতাল ও জেলা প্রশাসনের তরফে তৈরি ক্ষুদিরাম সাংস্কৃতিক মুক্তমঞ্চ। রানিবাঁধ পঞ্চায়েত সমিতি ও বারিকুল গ্রামপঞ্চায়েত এই উদ্যানটি পরিচালনা করে থাকে। স্কুলের উল্টোদিকে রাস্তার ধারে যে আমগাছগুলি বর্তমানে রয়েছে তার পাশেই একটি প্রাচীন আমগাছ ছিল। ওই গাছের তলাতেই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এলাকার মানুষ ও তাঁর সঙ্গে থাকা বিপ্লবীদের নিয়ে বৈঠক করতেন। বর্তমানে আমগাছটি মরে গিয়েছে। গুহার মুখ মাটিতে ঢাকা পড়েছে।
১৯০৭ সালের শেষের দিকে ছেঁদাপাথর অম্বিকানগর রাজবাড়ির অধীনে ছিল। তৎকালীন অম্বিকানগরের রাজার সঙ্গে মেদিনীপুরের রাজা দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিকেতনের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে দিগম্বরবাবুর মতোই অম্বিকানগরের রাজাও বিপ্লবী আন্দোলনে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন। দিগম্বরবাবুর অনুরোধেই অম্বিকানগরের তৎকালীন রাজা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু সহ তাঁর সঙ্গীদের আত্মগোপনের জন্য জঙ্গলঘেরা গ্রাম ছেঁদাপাথরের গুহায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। স্কুলের ঠিক পিছনে একটি টিলায় একটি গুহা ছিল। ওই গুহাতে এসে ক্ষুদিরাম বসু বিপ্লবীদের সঙ্গে আত্মগোপন করেছিলেন। বোমা বাঁধারও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ক্ষুদিরামের গোপন অস্ত্রভাণ্ডার ছিল এখানকার দুর্গম পাহাড়ে। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, নরেন গোস্বামী, বিভূতিভূষণ সরকার প্রমুখ বিপ্লবী এখানে গভীর জঙ্গলে আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে রাখার জন্য সুড়ঙ্গ কেটে গভীর আস্তানা তৈরি করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বোমা তৈরির জন্য জায়গাটি ছিল নির্জন ও নিরাপদ। বিপ্লবীদের পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণস্থলও ছিল এটি। সমগ্র অঞ্চলটি ব্রিটিশের নজর থেকে আগলে রেখেছিলেন অম্বিকানগরের রাজা রাইচরণ ধবলদেব। অম্বিকানগর থেকে বিপ্লবীরা গভীর রাতে ঘোড়ায় চেপে যেতেন দুর্গম ছেঁদাপাথরে। সেই সময় অম্বিকানগর থেকে ছেঁদাপাথরে যাওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না, ছিল শুধু জঙ্গল আর পাহাড়। আজকের পিচঢালা রাস্তা, যানবাহনের যাতায়াত দেখলে অতীতের ছেঁদাপাথরকে কল্পনাও করা যাবে না। ঘোড়ায় চড়ে যাবার পথে মাঝে মাঝে কেশরার তেঁতুলগাছে ঘোড়া বেঁধে বিশ্রাম নিতেন বিপ্লবীরা। বছরখানেক আগে ইতিহাসের সাক্ষী তেঁতুলগাছটি ঝড়ে উপড়ে যায়। ঠিক অনুরূপভাবে আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে গেছে ছেঁদাপাথরের প্রাচীন এক আমগাছ, যে আমগাছের তলায় এক আদিবাসী মহিলা পাকা আম খাইয়েছিলেন ক্ষুদিরামকে।
পুরীর পাণ্ডার ছদ্মবেশে এক ব্রিটিশ গুপ্তচর অম্বিকানগরের রাজবাড়ির সিংহদ্বারের কুঠুরিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে বিপ্লবীদের গোপন কর্মকাণ্ডের নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। শেষে একদিন ব্রিটিশ পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট নিজে দলবল সহ ঘাঁটিটির উদ্দেশে অভিযান চালায়। কাঁসাই ও কুমারী নদীর সঙ্গমের কাছে ছিল লাউলাপাড়া বস্তি। সেখানে এসে টেগার্ট ও তার দল থামতে বাধ্য হয়। কারণ বর্ষায় আক্রান্ত দুই নদীতেই ছিল তখন প্রবল বন্যা। খেয়া পারাপারের নৌকো সহজলভ্য ছিল না। এদিকে রাজার অনুগত পানু রজক নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, ভরা নদী সাঁতার দিয়ে পার হয়ে ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী আসার খবর রাজার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই সুযোগে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র নদী তীরবর্তী এলাকার মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। অভিযান নিষ্ফল বুঝে টেগার্ট সে যাত্রায় ফিরে গিয়েছিল। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের অস্ত্রাগারের খবর ফাঁস হয়ে যায়।
সুদীর্ঘকাল পর অবশেষে প্রশাসনিক উদ্যোগের দেখা মিলেছে। ২০১৯ এর শেষদিকে রানিবাঁধের বিডিও এবং বাঁকুড়া জেলা পর্যটন বিভাগের আধিকারিকরা এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপরই তারা পর্যটন দপ্তর এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। রানিবাঁধের বিডিও বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা ছেঁদাপাথরে ক্ষুদিরাম বসু স্মৃতিবিজড়িত এলাকাটি সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যায়নের মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এলাকাবাসীর আবেদনের কথা মাথায় রেখে, ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিষয়টি যাচাই করার জন্য আমরা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাহায্য চেয়েছি। এজন্য এলাকার মাপজোক করে প্রয়োজনীয় ছবি তুলে ইতিমধ্যেই এই আবেদন জেলাস্তরে পাঠিয়েছি। জেলাস্তর থেকেও রাজ্যস্তরে আবেদনের প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে”।
◆ যাতায়াত :-
কোলকাতার থেকে ঝিলিমিলি বা বাঁকুড়ার বাসে (ভায়া – শিলদা) প্রায় ৬ ঘন্টায় ফুলকুসুমা নেমে গাড়ি ভাড়া করে জঙ্গলের রাস্তায় ১৫ কিমি দূরে ছেঁদাপাথর হাইস্কুল। ওখানে পৌঁছে থেকে ত্রিপুরা মাহাতোর সঙ্গে দেখা করুন। উনিই আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে নির্দিষ্ট গুহায় পৌঁছে দেবেন। তবে নিজস্ব গাড়ি বা বাইক থাকলে সবচেয়ে সুবিধা।
◆ থাকার জন্য :
ঝিলিমিলি রিমিল লজ (8538834031) – ২০ কিমি,
◆ আশেপাশে :
ভৈরববাঁকি নদীর ওপর জাঁতাডুমুর ড্যাম – ৭ কিমি
সুতান ফরেস্ট – ৭ কিমি
তালবেড়িয়া ড্যাম – (২৪ কিমি)
রানিবাঁধ – ২০ কিমি
বেলপাহাড়ি – ২৫ কিমি
◆ জরুরী তথ্য :
গুহা চত্ত্বরে বা জঙ্গলে সাপ থাকতে পারে।
লোকাল মানুষের সাহায্য ছাড়া গুহার কাছে যাবেন না।
শুকনো খাবার, জল ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে রাখবেন।
জরুরী প্রয়োজনে বারিকুল থানার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন (ফোন – 9083269332)।