✍️কলমে: অরূপম মাইতি
(পর্ব–৫)
বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ করে স্বদেশী আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যে এসেছিল। তবে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে। ১৩১২ থেকে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের মধ্যে বহু পত্রপত্রিকায় স্বদেশ-চেতনার প্রতিফলন স্বরূপ আলোচিত হত সমকালীন রাজনীতি। স্বাদেশিকতা বোধ জাগরণে সক্রিয় ভূমিকা নিত এসব পত্রিকা। সেই কারণে, এদের বলা হত ‘স্বদেশী পত্রিকা’। ‘আর্যদর্শন’(১৮৭৫, সম্পাদনায় যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ), ‘বঙ্গবাসী’(১৮৮১, সম্পাদনায় যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু), ‘সঞ্জীবনী’ (১৮৮১, সম্পাদনায় কৃষ্ণকুমার মিত্র), ‘হিতবাদী’ (১৮৯১, সম্পাদনায় কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য), ‘ডন’ (১৮৯৭, সম্পাদনায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়) প্রমুখ পত্রিকায় স্বদেশী ভাবধারার প্রকাশ ছিল উল্লেখযোগ্য।
এমন অনেক স্বদেশী পত্রিকার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। পালন করেছেন বিবিধ ভূমিকা। কখনও উপদেষ্টা, কখনও লেখক আবার কখনও বা নিছক পাঠক। এমন কি শেয়ার কিনেও সহায়তা করেছেন পত্রিকাকে। তবে এসব কিছুর মধ্যে পত্রিকা সম্পাদনার কাজে তাঁর কৌতুহল ছিল অপরিসীম। ভাণ্ডার পত্রিকা ১ম ভাগ বৈশাখ ১৩১২ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন
“ব্যাধের বাঁশি শুনিয়া হরিণ যে কারণে ধরা দেয়, আমারও সেই একই কারণ। অর্থাৎ তাহা কৌতুহল, আর কিছুই নহে। দেশের যে সকল লোক নানা বিষয়ে নানরকম ভাবনাচিন্তা করিয়া থাকেন, তাঁহারা কি ভাবিতেছেন জানিবার যদি সুযোগ পাওয়া যায়, তবে মনে ঔৎসুক্য না জন্মিয়া থাকিতে পারে না।….”
বঙ্গাব্দ ১৩০৫ ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে এলেন রবীন্দ্রনাথ। এক বছর পালন করেছিলেন দায়িত্ব। বলা বাহুল্য, তাঁর এই অভিজ্ঞতাও সুখকর হয়নি। সম্পাদকের পদ থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের সম্পাদকদের পত্র সম্পাদন হালগোরুর দুধ দেওয়ার মত – সমস্ত দিন ক্ষেতের কাজে খাটিয়া কৃষ্ণ প্রাণের রসাবশেষটুকুতে প্রচুর পরিমাণে জল মিশাইয়া যোগান দিতে হয়।”
সম্পাদকের ভূমিকায় ‘সাধনা’ পত্রিকাকে নিজস্ব ভাবনায় দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন ‘ভারতী’-কে। ‘ভারতী’ সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে চেয়েছিলেন সেই স্বপ্নকে পুনর্জীবিত করতে। প্রচলিত ধারণার অবসান ঘটিয়ে সব বিভাগের রূপান্তর করেছিলেন। ‘গ্রন্থ সমালোচনা’, ‘সাময়িক সাহিত্য’, ‘প্রসঙ্গ কথা’ প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগের জন্য নিয়মিত লিখতে শুরু করেছিলেন। এই ‘ভারতী’-র মাধ্যমে সমকালীন রাজনীতি নিয়েও নিজস্ব বক্তব্য পেশ করতেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে একবার লিখেছিলেন, “সাধনা আর বাহির করিবার প্রয়োজন থাকিবে না। ভারতীর দ্বারাই আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করিতে হইবে।”
বঙ্গদর্শন পত্রিকার পাশাপাশি ভারতী পত্রিকা একটি সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের যত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ প্রবন্ধ লিখে শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ‘সাধনা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে গল্প রচনায় সাময়িক রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ স্তিমিত হয়েছিল। যে কোন পত্রিকা যে কোন সময় বন্ধ হলে, লেখক থেকে শুরু করে পাঠক এবং সর্বোপরি সম্পাদকের মনে কি পরিমাণ হতাশা ও আক্ষেপ তৈরি হয়, তা বোধকরি বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না। তবে অজিত চক্রবর্তী মন্তব্য করেছিলেন, রবীন্দ্রপ্রতিভার সর্বাঙ্গীন বিস্তার প্রকৃতপক্ষে ‘সাধনা’-র সময়ে হয়েছিল এবং সেই অর্থে যথার্থভাবে সেই সময় ছিল রবীন্দ্রনাথের সাধনার কাল।
১২৭৯ বঙ্গাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ প্রথম প্রকাশিত হয়। চার বছর দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। তারপর ‘বঙ্গদর্শন’ বন্ধ হয়ে যায়। কিছু দিন বন্ধ থাকার পরে পুনরায় রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। ১৩০৮ থেকে ১৩১২ পর্যন্ত তিনি সম্পাদনার কার্যভার চালিয়েছেন।
(ক্রমশঃ)