নিজস্ব সংবাদদাতা: ‘এতদিন টিভিতে দেখেছি, কাগজে পড়েছি, শুনেছিলাম কলকাতায় নাকি এরকমটা হচ্ছে। কিন্তু খড়গপুরে আমাদের সঙ্গেও এমনটা হবে ভাবতেও পারিনি। চেনা মানুষগুলো কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনও সাহায্য করছেনা। পুলিশের দেওয়া নম্বর ফোনই তুলছেনা। দুরের এক আত্মীয় দু’বেলা রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে যায়, তাই খেতে পাচ্ছি। ২ঘন্টা আ্যম্বুলেন্সের জন্য লড়ে গেছি কিন্তু কেউ আসেনি। শেষ মেশ একটা টোটো যোগাড় করে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসি তখন প্রায় সব শেষ! এ কোন শহর খড়গপুর!” মঙ্গলবার রাতে এমনই আক্ষেপ আর কান্না ঝরে পড়ল তরুনীর গলায়। পরিবারের কারও করোনা হলে পুরো পরিবারের কী হয় তাই ধরা পড়ল এই মর্মান্তিক ঘটনায়।
তিন তিনটে স্টোক, অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রেল হাসপাতালে। অবস্থা কিছুটা উন্নত হওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। ওই দিনই কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ে বৃদ্ধের স্ত্রী ও ছেলের। ছেলে অপেক্ষাকৃত সুস্থ থাকায় বাড়িতেই থাকে কিন্তু স্ত্রীর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় আনা হয় রেলের কোভিড ওয়ার্ডে। ক্রমশঃ বৃদ্ধার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ায় শালবনী হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয় কিন্তু শালবনীতে শয্যা খালি না থাকায় রেল কলকাতার একটি বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে বৃদ্ধাকে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা নেয়। মঙ্গলবার সকালে রেলের তত্বাবধানে বৃদ্ধাকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতা। এদিকে মঙ্গলবারই বিকালে প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বৃদ্ধের। পরিবার যোগাযোগ করে রেল হাসপাতালের সাথে। রেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, এখন স্যানেটাইজ চলছে, হাসপাতাল বন্ধ। ভর্তি নেওয়া যাবেনা। তারা পরামর্শ দেয় খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বিকাল থেকেই শুরু হয় আ্যম্বুলেন্সের খোঁজ কিন্তু কেউ রাজি হয়না। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটা টোটো যোগাড় হয় অবশেষে। তাতে করেই পরিবারের লোকেরা নিয়ে আসে খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাত ৮টা নাগাদ মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। আপাতত হিমঘরে বৃদ্ধের দেহ। বুধবার করোনা পরীক্ষার পরই ঠিকানা পাবে মৃতদেহ, পরিবার নাকি প্রশাসন, কে দায়িত্ব নেবে শবযাত্রার।
ঘটনা খড়গপুর শহরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড মিরুপুরের যেখানে একটি করোনা আক্রান্ত পরিবারের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা পরিবারের দুই বয়স্ক সদস্যকে ঘিরে যেখানে একজন অসুস্থ মানুষের জন্য তার নিজের হাসপাতাল জোটেনি আর যদিও বা হাসপাতাল জুটল কিন্তু কয়েকঘন্টার চেষ্টাতেও একটা আ্যম্বুলেন্স জোটেনি। পরিবারের অভিযোগ, যথেষ্ট সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই শুক্রবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৮৪ বছরের বৃদ্ধকে। কারন রেল দ্রুত হাসপাতাল খালি করতে চাইছিল স্যানেটাইজ করার লক্ষ্যে। যদি রেল তড়িঘড়ি করে বাড়ি না পাঠানো হত তাহলে বৃদ্ধ বেঁচে থাকতেন ।
এদিকে পরিবারের অন্য সদস্যরা কিছু উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে নিজেদের নমুনা দিতে যায়। এরপরই ওই বৃদ্ধের স্ত্রী এবং সন্তান পজিটিভ আসে। প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধা, যার পেসমেকার রয়েছে এবং ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে। রবিবার রেলের কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি করে নেওয়া হয় কিন্তু অবস্থা সঙ্কট জনক হওয়ায় তাঁকে শালবনীতে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় কিন্তু শালবনীতে শয্যা নেই বলে বৃদ্ধাকে নিতে অস্বীকার করা হয়। এরপর মঙ্গল সকালে রেল কলকাতা পাঠায়।
এদিকে বিকালেই বৃদ্ধের প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অবস্থা সঙ্গিন হতে থাকায় পরিবার যোগাযোগ করে রেল হাসপাতালের সাথে। হাসপাতাল জানিয়ে দেয় যেহেতু স্যানেটাইজ চলছে তাই তারা ভর্তি নিতে পারবেনা। পরিবার বরং খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে দেখুক। এবার শুরু আ্যম্বুলেন্স খোঁজা। রেল যেমন হাসপাতাল দেয়নি তেমনই দেয়নি আ্যম্বুলেন্স। একের পর এক আ্যম্বুলেন্স মালিককে ফোন করা হয় কিন্তু কোনও আ্যম্বুলেন্স মেলেনি। শুধু নিজেরাই নয়, চেষ্টা করেন বন্ধু বান্ধবরাও, কাজ হয়নি। শেষ অবধি একজন টোটো চালক সহৃদয় হন। তাতেই দুমড়ে মুচড়ে বৃদ্ধকে নিয়ে যাওয়া হয় খড়গপুর হাসপাতালে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে মৃত্যু হয় তাঁর।
তরুনী জানালেন, “জন্মের পর ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এই শহরে। স্কুল, কলেজ, চাকরি সবই এখানে। কত বন্ধু বান্ধব? পরিচিত মানুষ! সব যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে রাতারাতি। অসহায়, সম্বলহীন হয়ে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পড়ে রয়েছি আমরা। সেই দ্বীপের নাম করোনা!”