✍️কলমে: অরূপম মাইতি
( পর্ব-৩)
সমাজ গঠন কর্মে সাময়িক পত্রিকা বা ছোট পত্রিকার অবদান বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প, সাহিত্য বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য পাঠককে অবহিত করাতে ও তাদের স্বাধীন মতামত গড়তেও সাময়িক পত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এই প্রয়োজন বঙ্কিমচন্দ্র অনুভব করেছিলেন। নিজস্ব মত ও বক্তব্য, বড় পরিসরে বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে, তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করেছিলেন এবং বলাই বাহুল্য, সুফলও পেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম ছিলেন না। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৭ই জ্যৈষ্ঠ (ডিসেম্বর ১৮৯১) ‘হিতবাদী’ প্রকাশ শুরু হয়। এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও মাত্র তিন মাস তিনি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ নিজ মতামত স্বাধীনভাবে বলতে পারছিলেন না। তাই নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ‘হিতবাদী’ প্রকাশের কয়েক মাস পরে, ‘সাধনা’ নামে একটি পত্রিকার শুভ সূচনা হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১২৯৮। ‘বঙ্গদর্শন’-এর মতো ‘সাধনা’ও মাত্র চার বছর চালু ছিল। প্রথম তিন বছর অর্থাৎ ১৩০১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস পর্যন্ত, সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ। তখন তার বয়স মাত্র বাইশ আর রবীন্দ্রনাথের ত্রিশ।
রবীন্দ্রনাথ যেসব পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা যথাক্রমে, সাধনা (১২৯৮ – ১৩০২), ভারতী (১৩০৫), নবপর্যায় বঙ্গদর্শন (১৩০৮ – ১৩১২), ভাণ্ডার (১৩১২–১৩১৪) এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৩১৮–১৩২১)। ১৩০১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ‘সাধনা’-র সম্পাদকের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে সম্পাদক হিসাবে যারই নাম থাক, পত্রিকার শুরু থেকে সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে একটি পত্রে কবি লিখেছেন, “সাধনা পত্রিকার অধিকাংশ লেখা আমাকেই লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকদের রচনাতেও আমার হাত ভুরি পরিমাণে ছিল।”
বলতে গেলে, ‘সাধনা’ সম্পাদনার মাধ্যমে, সাময়িক পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা কর্মে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ হয়। ‘ছিন্নপত্রাবলী’-তে তিনি লিখেছেন, “সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্য একে আমি ফেলে রেখে মরতে পড়তে দেব না – একে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরও আমার সহায়কারী পাই তো ভালোই, না পাই তো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।”
সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকে ‘সাধনা’ অর্থ সঙ্কটে ভুগছিল। রবীন্দ্রনাথও সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেননি। পরিস্থিতির উন্নতি সাধনে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পত্রিকা ত্রৈমাসিক আকারে প্রকাশ করবেন। তবে সে চেষ্টাও বিফলে যায়। ১৩০২ বঙ্গাব্দে তাঁর সম্পাদনায়, পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক যে যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটাই ‘সাধনা’-র শেষ সংখ্যা।
গুরুদেবের ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘সাধনা’র প্রসঙ্গ সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ‘সাধনা’র উল্লেখ রয়েছে একাধিকবার।
“ আজকাল কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখসম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে। এদিকে আগামী মাসের সাধনার জন্যে একটি লাইনও লেখা হয়নি, ওদিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া আসছে, অনতিদূরে আশ্বিন কার্তিকের যুগল সাধনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করছে, আর আমি আমার কবিতার অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি।……” ( ৩০ শে আষাঢ়, ১৩০০)।
“কাল বিকেলে সাধনার জন্য একটা গল্প লেখা শেষ করে আজ কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছি। দুপুরবেলাটিও খুব নিস্তব্ধ এবং গরম এবং শান্ত এবং স্থির হয়ে আছে….” ( ১৬ ফাল্গুন , ১৩০১)।
“আজ আমি এক অনামিকা চিঠি পেয়েছি। তার আরম্ভই হচ্ছে –
পরের পায়ে ধরে প্রাণ দান করা
সকল দানের সার।
তারপরে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। আমাকে সে কখনও দেখে নি, কিন্তু আজকাল আমার ‘সাধনা’র মধ্যে সে আমাকে দেখতে পায়। তাই লিখেছে – তোমার সাধনায় রবিকর পড়িয়াছে, তাই রবি-উপাসক যত ক্ষুদ্র যত দূরে থাকুক তবু তার জন্যেও রবিকর বিকীর্ণ হইতেছে।….” ( ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৫ )।
অনেক পত্রাংশের মধ্যে মাত্র তিনটি উদাহরণ অনুসরণ করলে, ‘সাধনা’ নিয়ে তাঁর অসীম উৎসাহ ও ভাবাবেগের সন্ধান পাওয়া যায়।
(ক্রমশঃ)