হিন্দু ধর্মে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় দেবতাদের মধ্যে একজন হলেন শিব। তাঁকে বলা দেবাদিদেব। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। শাস্ত্র মতে, ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন আর শিব ধ্বংস করেন। প্রলয়কালে তিনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে সব কিছু ধ্বংস করেন, তাই তাঁর অপর নাম মহাকাল। তিনি একাধারে মহাযোগী, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও কঠোর তপস্যাকারী। তাঁর তপস্যাস্থল হিমালয়। ভক্তিভরে শুধু একটি বিল্বপত্র দিলেই তিনি খুশি। পুরাণ অনুসারে, শিবের বাড়ি কৈলাস পর্বতে। তাঁর জীবন সঙ্গিনী হচ্ছেন সতী (পরে পার্বতী, উমা বা দুর্গা); আর কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তাঁদের পুত্রকন্যা। চলুন আজ শিবের আরেক বাড়ি, শিবগাডির গল্প শোনাই।
শিবগাডির প্রবেশ-তোরণ পেরিয়েই, সামনে গুণে গুণে ৯৫টি সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙ্গে, তবে গজেশ্বরনাথ বাবার গুহা-মন্দির। পাহাড়টা দেখতে অনেকটা বিশাল এক গজরাজের মতো। মন্দিরের প্রবেশ পথে প্রাচীণ ও দূর্লভ অক্ষয় বটবৃক্ষ। চারদিকে সেই বটের ঝুরি নেমে গেছে। ভগবান শিবের জটা বলে লোকমুখে প্রচলিত। বুদ্ধগয়াতেও এরকম একটি বৃক্ষ আছে। এছাড়াও, মন্দিরের দরজার পাশে আছে ‘কল্পতরু’ বা মনোকামনা বৃক্ষ।
পাহাড় কেটে বানানো এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করলে সারা শরীর-মনে কেমন একটা শিহরণ জাগে। প্রধান শিবলিঙ্গটি পিতলের। তাছাড়াও, একটি পাথরের শিব মূর্তি, একটি গণেশ মূর্তি এবং আরও কয়েকটি শিবলিঙ্গ আছে। শিবলিঙ্গের মাথায় ঝর্ণার বারিধারা বিন্দু বিন্দু আকারে সারাবছর ঝরে পড়ে। পাহাড়ী ঝর্ণার ক্ষীণ বারিধারা কিছুটা মন্দিরের গা বেয়ে গুহার বাইরেও ঝরে পড়ে।
এই মন্দির আর দেবতার বিগ্রহের উদ্ভবের সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এক পুরাণ-কাহিনী। ‘শিব পুরাণ’ অনুসারে, মহিষাসুরের পুত্র গজাসুর এই দূর্গম পাহাড়ে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন এবং পায়ের আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে শিবের তপস্যা শুরু করেন। কঠিন কায়িক ক্লেশ সহ্য করে তপস্যা করে যেতে থাকেন গজাসুর। ভগবান শিব সন্তুষ্ট হয়ে গজাসুরকে অসীম পরাক্রমশালী হওয়ার বরদান করেন। বর লাভ করে, গজাসুর নিজ রূপ ধারন করেন। ঋষি-মুনিদের উপর নিদারুণ অত্যাচার শুরু হয়। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, অগত্যা ঋষি-মুনিরা ভগবান শিবের স্মরণাপন্ন হলেন। তাঁদের করুণ আর্তি আর অত্যাচারের কথা শুনে, শিব গজাসুরকে সংহার করেন।
মৃত্যুর পূর্বে গজাসুর শিবের স্তুতি করেন। শিব আবার প্রসন্ন হলেন গজাসুরের উপর। বর দিয়ে বললেন– এই স্থানে গজাসুরের প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ ‘গজেশ্বরনাথ’ নাম পূজিত হবে এবং স্থানটি প্রসিদ্ধ হবে ‘গজেশ্বরধাম’ নামে। শিব নন্দীর (ষাঁড়) পিঠে চড়ে গজাসুরকে বধ করার সময়, নন্দীর ক্ষুরের আঘাতে একটি বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। যেটি পরবর্তীকালে ‘শিবগঙ্গা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
হাজার হাজার বছর পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা এই গুহাটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। ইতিহাস অনুসারে, আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রথম মানুষের নজরে আসে এটি। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা মানসিংহ গুহা-মন্দির এবং সংলগ্ন রাস্তাটি সংস্কার করেন। তাতে ভক্তজনের সমাগম সূচিত হয়। প্রথম প্রথম আদিবাসী মানুষেরা এখানে পূজার্চনা করতেন। রাজমহল থেকে গঙ্গার জল তুলে আনতেন তাঁরা। কেবল তা দিয়েই পূজো হোত এখানে। শোনা যায়, সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই নায়ক সিধু ও কানহু এই মন্দিরে পূজো দিতে আসতেন।
গুহার উৎপত্তি প্রসঙ্গে, ভৌগলিক অভিমত কিন্তু আলাদা। ভূতত্ত্ববিদেরা বলেন, এই গুহা আগ্নেয় প্রবাহের ফল স্বরূপ, প্রাকৃতিক কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল। লাভা প্রবাহের বাইরের অংশ জমে শক্ত হয়ে যাওয়ার পরে, এই গুহামুখ দিয়ে ভিতরের তরল লাভা বেরিয়ে আসত। অনুমান করা যেতে পারে, হয়তো প্রাচীন প্রস্তর যুগের আদিম মানুষেরা এই গুহাতেও আশ্রয় নিত।
আদিবাসীদের সেই প্রাচীণ ঐতিহ্য আজও প্রচলিত আছে। সেটিকে প্রথা হিসাবে মান্য করা হয়। এখনও বাবা গজেশ্বরনাথের ‘জলাভিষেক’ করা হয় গঙ্গা থেকে পবিত্র জল নিয়ে এসে। প্রতিবছর শিবরাত্রি ও সারা শ্রাবণ মাসে বাংলা ও ঝাড়খন্ড থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী এখানে জল ঢালতে আসেন। মেলাও বসে এখানে। সেসময় শিবগাডি প্রবন্ধ সমিতির পক্ষ থেকে নিঃশুল্ক ধর্মশালা, প্রসাদ, শৌচাগার, পানীয় জল, মেডিক্যাল ক্যাম্প, পার্কিং ইত্যাদির সুব্যবস্থা করা হয়।
◆ কিভাবে যাবেন :-
নিকটবর্তী রেলস্টেশন বারহারওয়া (ঝাড়খন্ড)। হাওড়া থেকে জামালপুর এক্সপ্রেস, শিয়ালদহ থেকে বারণসী এক্সপ্রেস ও আনন্দবিহার এক্সপ্রেস যায়। বারহারওয়া স্টেশন থেকে অটোতে সরাসরি বারহেট হয়ে শিবগাডি (২৬ কিমি) । বারহেট মোড়ে রাস্তার উপর এক বিশাল তোরণ বানানো হয়েছে শিবগাডির যাত্রীদের আকর্ষন করার জন্য। বারহেট মোড় থেকে শিবগাডির দূরত্ব ৬ কিমি। এপথেই গুমনী নদীর ব্যারেজ দেখে নেবেন।
◆ কোথায় থাকবেন :-
থাকার জন্য মন্দির কমিটির গেস্ট হাউস নির্মানের কাজ চলছে (যোগাযোগ – 9939754814 / 8521053990)। তবে বারহেট বাজারে দুটি থাকার লজ আছে। তার মধ্যে একটি – জয়সওয়াল লজ (7677506161 / 9608979179)। এছাড়া বারহারওয়া স্টেশনে অনেক লজ ও হোটেল আছে।
◆ কোথায় খাবেন :-
শিবগাডি মন্দিরের কাছে একমাত্র নিরামিষ হোটেল “বাবা রেস্টুরেন্ট”। তাছাড়া বারহেট বাজারে অনেক আমিষ রেস্টুরেন্ট আছে তার মধ্যে সবথেকে ভালো ‘পুষ্পাঞ্জলি রেস্টুরেন্ট’।
পাশাপাশি যা দেখতে পারেন:-
বারহারওয়া স্টেশন থেকে ২ কিমি দূরে সতীপীঠ মাতা বিন্দুবাসিনীর মন্দির বা বিন্দুধাম অবশ্যই ঘুরে আসবেন। বারহেট থেকে ৬ কিমি দূরে সিধু কানহুর গ্রাম ভোগনাডিহি ও পঞ্চকটিয়া যেতে পারেন। এখান থেকে আরো দুদিন সময় হাতে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঊধয়া পাখিরালয়, রাজমহল, বারদ্বারি, জামি মসজিদ, কাঠঘর গ্রাম, কানাইয়া স্থান, মোতি ঝরণা ইত্যাদি