জলের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ। তার মাঝে রঙীন ঘরবাড়ি ও মন্দির। জলের ধারে সারি সারি নারিকেল গাছ। অনেকটা যেন কেরালার ব্যাকওয়াটার। প্রতিটি বাড়ির ব্যবহারের জন্য এক একটি ঘাট রয়েছে। ঘাটে প্রত্যেকের নিজস্ব একটি করে নৌকা বাঁধা। বাজার–হাট, দরকারী কাজে বা ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া আসা অথবা কোন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে যেতে হলে, আগে এই নৌকাতেই জল পেরোতে হবে। রাজ পরিবারের প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রাখতে, বাসিন্দারা এখানে কোন সেতু বানাননি। কোন অতিথিকে অভ্যর্থনা বা বিদায় জানাতে আমরা স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড বা বিমানবন্দরে যাই। এখানে কারো বাড়িতে অতিথি এলে, বাড়ির যে কোন সদস্য, সে বাচ্চা হোক বা বড়, নৌকা নিয়ে এপারে অপেক্ষা করেন পরিবারের কেউ। আবার ফেরার সময় নৌকায় করে এপারে পৌঁছে দিয়ে যান। এমনই বিশিষ্ট জায়গাটি হল পূর্ব মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক ময়নাগড়।
আনুমানিক দশম শতাব্দীতে, ধর্মমঙ্গল খ্যাত কিংবদন্তী লাউসেনের রাজধানী ছিল এই ময়নাগড়। কালিদহ ও মাকড়দহ নামক দুটি পরিখা বেষ্টিত ময়নাগড় বা ময়নাচৌরা। এটি আগে ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তখন ওড়িশার দন্ডপাটের সংখ্যা ৩১টি। তার মধ্যে অবিভক্ত মেদিনীপুরে ছিল ৬টি দন্ডপাট। ময়নাগড় জলৌতি দন্ডপাটের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মেদিনীপুরের অন্তর্ভূক্ত জলৌতি দণ্ডপাটের মধ্যে আবার ছিল তিন পরগণা— সবং, খান্দার (বর্তমান পিংলার একাংশ) ও ময়না। সেই ময়না পরগণার বৃহৎ অংশই আজকের ময়না ব্লক এলাকা। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রক্ষিত বিখ্যাত ‘মাদলা পঞ্জী’–তে ময়না চৌরা নামে জায়গার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাজা লাউসেনের রাজত্বের পর, ময়নাগড়ের শাসক কারা ছিলেন, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে। ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে এর সদর দপ্তর ছিল বালিসীতাগড়। গবেষকদের মতে, এই ময়নাগড় একসময় জলদস্যু শ্রীধর হুই এর হস্তগত হয়। শ্রীধর পার্শ্ববর্তী এলাকায় দস্যুবৃত্তি করে বেড়াত। তাকে সাহায্য করত মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা। তবে শ্রীধরকে শায়েস্তা করতে তৎপর হন ওড়িশার রাজা।
আদেশে সবংয়ের রাজা গোবর্দ্ধনানন্দ ময়নাগড় আক্রমণ করেন এবং শ্রীধরকে পরাজিত করেন। ওড়িশার রাজা খুশি হয়ে, গোবর্দ্ধনানন্দকে “বাহুবলীন্দ্র” উপাধি প্রদান করেন। রাজা গোবর্দ্ধনানন্দ ময়নাগড়ে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করে আনেন। গোবর্ধনানন্দের রাজত্বকাল আনুমানিক ১৫৬২–১৬০৭ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পুত্র পরমানন্দের হাতেই ময়নার দক্ষিণ অংশে পরমানন্দপুর গ্রামের পত্তন হয়েছিল। আবুল ফজল–এর লেখা ‘আইন–ই–আকবরী‘ গ্রন্থে ময়নাগড়ের উল্লেখ আছে। সেসময় এখানে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা উপাসনাস্থল ছিল। কয়েক বছর আগে রাজ্য প্রত্নতত্ব বিভাগ ময়নাগড়কে হেরিটেজ স্বীকৃতি দিয়েছে। কাঁসাই নদীর তীরবর্তী ময়নাগড় এলাকাকে কেন্দ্র করে গড় সাফাৎ, গড় ময়না, আনন্দপুর, দক্ষিণ ময়না, পূর্ব দক্ষিণ ময়না প্রভৃতি এলাকা নিয়ে যে বাজার–হাট ও বসতি এলাকা গড়ে উঠেছে, তা এখন ময়না ব্লকের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।
বাহুবলীন্দ্র রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যরা এখনও চারিদিক পরিখাবেষ্টিত এই ময়নাগড়ে বসবাস করছেন। এবং এই পরিবার বংশানুক্রমে নামের পরে বাহুবলীন্দ্র পদবী ব্যবহার করেন। গড়ের মধ্যে রাজপরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জীউ ও লোকেশ্বর জীউর মন্দির আছে। গড়ের বাইরে আছে, কামেশ্বর শিব–এর মন্দির। প্রতি বছর রাসপূর্ণিমার সন্ধ্যায় শ্যামসুন্দর জীউর নৌ–রাসযাত্রা দেখতে দূরদুরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। দেবতার রাস–মঞ্চটি পরিখা পার হয়ে, গড়ের বাইরে। উৎসবের সময় রঙীণ আলোকমালা ও ফুলে সজ্জিত নৌকা ভাসানো হয় পরিখায়। তাতে চড়ে, হরিনাম সংকীর্তন ও ব্যান্ড পার্টি সহযোগে শ্যামসুন্দর জীউ গড়ের চারদিক প্রদক্ষিণ করেন।
দেবতার বিগ্রহ নিয়ে সে এক স্বপ্নময় নৌ–যাত্রা। রাস উৎসবের এমন দৃষ্টান্ত বাংলায় কোথাও নাই। পরিক্রমা শেষে, এপারের রাসমঞ্চে এনে স্থাপন করা হয় শ্যামসুন্দরকে। আকাশে তখন হাজারো রকমের আতসবাজির রোশনাই। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে হাজার হাজার দর্শনার্থীর আনন্দ কোলাহলে। রাস উপলক্ষে বড় আকারের একটি মেলারও আয়োজন হয়, এক পক্ষকাল অর্থাৎ পনের দিন ব্যাপি বিস্তার সেই মেলার।
উৎসবের দিনগুলিতে রাজপরিবারের আগোল খুলে যায়। যাত্রী সাধারণ পরিখার জলে নৌকাবিহার করতে পারেন। গড়ের মধ্যে প্রবেশও অবাধ। ভগ্ন রাজবাড়ি, শ্যামসুন্দর জীউ ও লোকেশ্বর শিব–এর মন্দির দর্শন করা যাবে। ২৫০ বছরের প্রাচীণ একটি কাঁঠাল গাছ আছে। রাসমঞ্চকে কেন্দ্র করে বসা সেই মেলায় প্রতিদিন নানাধরনের প্রতিযোগিতামূলক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ময়নাগড়ের রাসমেলার বিখ্যাত পসরা হোল— চিনির বড় কদমা আর থালা বাতাসা। ঘরে ফেরার সময়, এ দুটি জিনিস কিনতে ভোলেন না মেলাযাত্রীরা।
কিভাবে যাবেন :-
◆ হাওড়া থেকে সকালের হলদিয়াগামী লোকাল ট্রেনে অথবা সাঁতরাগাছি থেকে দীঘাগামী লোকাল ট্রেনে প্রায় আড়াই ঘন্টায় শহীদ মাতঙ্গিনী বা তমলুক স্টেশনে নেমে শ্রীরামপুর / ময়না যাওয়ার বাস, ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়ি পেয়ে যাবেন (২৩ কিমি)। অথবা দঃপূঃ রেলের মেচেদা স্টেশন থেকেও শ্রীরামপুর যাওয়ার বাস, ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়ি পেয়ে যাবেন (৩৮ কিমি)।
◆ হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে দীঘা/হলদিয়াগামী সরকারি বাসে দুঘণ্টায় নিমতৌড়ি মোড়ে নেমে, বাস বা ট্রেকারে ময়না যাওয়া যাবে (১৮ কিমি)। অথবা ধর্মতলা থেকে বলাইপন্ডা যাওয়ার দুএকটি বাস সরাসরি ময়না হয়ে যায়।
◆ খড়গপুরের দিক থেকে কেউ যেতে চাইলে বালিচক হয়ে যেতে হবে।
কোথায় থাকবেন :-
ময়নাতে কোন থাকার হোটেল নেই। রাতে থাকতে চাইলে নিকটবর্তী নিমতৌড়িতে অনেক হোটেল–লজ পাবেন।