বিভূ কানুনগো : কারও দেহ পড়ে রয়েছে শনিবার থেকে কারও রবিবার আবার কারও দেহ পড়েছিল মঙ্গলবার থেকে কিন্তু ঠিকানা মিলেছিল না শ্মশানের ফলে চরম উদ্বেগে দিন কাটছিল পরিবার গুলির। তিন জনই রেল পরিবারের সদস্য আর করোনা আক্রান্ত হয়ে কো-মর্বিডিটি জনিত কারণে মৃত্যু হয়েছিল তাঁদের। মৃত্যুর পর তিনটি দেহই রাখা ছিল রেলের মৃতদেহ রাখার জায়গায় বা মরচুয়ারিতে। রেলের তরফে রাজ্য সরকারকে জেলা প্রশাসনকে জানানোর পরও দেহগুলি সৎকারের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ফলে দেহ গুলি পড়েই ছিল।
এদিকে প্রিয়জনের দেহের সৎকার না হওয়ায় উৎকন্ঠায় দিন কাটছিল পরিবার গুলির। অবশেষে সেই দেহগুলি সৎকার করা হল বুধবার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মৃতের পরিবারবর্গ। মৃতদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে শনিবার থেকে হাসপাতাল মরচুয়ারিতে রয়েছে ৯নংওয়ার্ডের বাসিন্দা লক্ষ্মীবাঈয়ের দেহ। তাঁর বয়স হয়েছিল তার সঙ্গে তিনি আবার ক্যানসার আক্রান্ত হয়েছিলেন। রেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হন তিনি। প্রাথমিক ভাবে আ্যন্টিজেন পরীক্ষায় তাঁর করোনা ধরা পড়ে এরপর নমুনা পাঠানো হয় আরটি/পিসিআর পরীক্ষার জন্য। সেই ফল আসার আগেই মৃত্যূ হয় তাঁর। শনিবারই দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মরচুয়ারিতে।
পরিবারের লোকেরা জানিয়েছে প্রথমে আরটি/পিসিআর রিপোর্ট আসেনি বলে দেহ দেওয়া হচ্ছিলনা তাঁদের। এরপর রিপোর্ট আসার পর তাঁরা জানতে পারেন যে দেহ প্রশাসনিক উদ্যোগে সৎকার করা হবে তাঁদের উপস্থিতিতে কিন্তু দিনের পর দিন তাঁরা রেলের দরজায় মাথা ঠুকছেন কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। রেল তাঁদের জানিয়ে দেয় রাজ্য পুলিশ যতক্ষন না দেহ নিতে না আসবে ততক্ষণ তারা মরচুয়ারি থেকে দেহ বের করতে পারবেনা। ফলে দেহ পড়েই থাকে।
একই অভিজ্ঞতা মৃত শিউ প্রসাদ সিংয়ের। রবিবার থেকে ইন্দা নিবাসী শিউপ্রসাদ সিং এর দেহ থেকে গিয়েছিল রেলের মরচুয়ারিতে। তাঁর পরিবার জানিয়েছে সরকারের যা নিয়ম আছে সরকার করুন তাতে তাঁদের আপত্তি নেই কিন্তু দিনের পর দিন দেহ পড়ে থাকাটা মৃতের প্রতি অসম্মান। তাছাড়া হিন্দু নিয়ম মতে মৃতের দেহ সৎকারের পর থেকেই পারলৌকিক ক্রিয়া শুরু হয়। মৃতদেহ দিনের পর দিন পড়ে থাকলে মৃতের পারলৌকিক ক্রিয়া করা যায়না। এতে যাঁদের এই ক্রিয়া করার কথা তাঁরা বিপদে পড়ে যান। নিয়ম কানুন শুরু করা যায়না। একই ভাবে মঙ্গলবার থেকে রয়েগেছিল আরামবাটি নিবাসী কানাইলাল দের দেহ। বিপদে পড়ে তাঁর পরিবারও। রেলের কর্তৃপক্ষর তরফে জানানো হয় যে তাঁরা প্রতিটি মৃত্যুর পরই স্থানীয় প্রশাসনকে তা অবহিত করেছেন পরের কাজ প্রাশাসনের। এক্ষেত্রে প্রশাসন না এগিয়ে এলে তাঁদের কিছুই করার নেই। তাঁরা চেষ্টা করেছেন মৃতদেহগুলো যাতে অবিকৃত থাকে সেই কাজ করতে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে খড়গপুরের কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃতদের সৎকারের জন্য মন্দির তলার বৈদ্যুতিক চুল্লিটি বরাদ্দ। সেই চুল্লিটি হঠাৎ করে খারাপ হয়ে পড়ায় সমস্যা হচ্ছিল। খড়গপুরের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মেদিনীপুরে। সেখানে আরও অন্য জায়গায় দেহ আসছে ফলে সময় লাগছিল অনেক। খড়গপুর পুলিশ জানিয়েছে যেহেতু তাঁদের কাছে প্রশাসনের তরফে কোনও নির্দেশ আসেনি তাই তাঁরা কিছু করতে পারছিলেন না। বুধবার বিষয়টি নিয়ে সরব হন খড়গপুরের ‘আমরা বামপন্থী’ সংগঠনের নেতা অনিল দাস। তিনি প্রথমে কথা বলতে ছুটে যান রেলের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বা সিএমএসের কাছে। তাঁর সাথে দেখা করে দেহগুলি যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি করে বলেন সৎকার করতে বলেন। রেল তাঁকেও নিজেদের অপারগতা জানায়। এরপরই অনিল দাস সম্পূর্ণ ঘটনা খড়গপুর মহকুমা শাসককে জানান। মহকুমা শাসক আজমল হোসেন জানান বুধবারই তিনি দায়িত্ব নেবেন দেহগুলি সৎকারের। এরপরই মহকুমা শাসকের উদ্যোগে বুধবার বিকালে খড়গপুর টাউন থানার পুলিশ রেলের মরচুয়ারি থেকে বের করে তিনটি দেহকে সৎকার করার জন্য নিয়ে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তারা প্রশাসনিক নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন সেই নির্দেশ আসার পরই তৎপরতার সাথে দেহ গুলি সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু মাত্র রেল যোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রশাসনিক জটিলতা দুর করা হচ্ছেনা কেন? এমনিতেই মৃতের পরিবার শোকের মধ্যে দিয়ে যান তার ওপর দিনের পর দিন মৃতের দেহ পড়ে থাকার উৎকণ্ঠা বইতে হয় তাঁদের। বিষয়টি যেমন মৃতের প্রতি অসম্মান তেমনই মৃতের পরিবারের প্রতি অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত। ৩টি পরিবারের পক্ষ থেকেই অনিল দাসকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। অনিল দাস জানান, ‘ জানি আমরা কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তার ওপর যাঁদের পরিবারের সদস্য বা সদস্যা মারা যাচ্ছেন তাঁদের অবস্থা আরও করুন। তাঁদের প্রতি একটু মানবিক হতে হবে আমাদের সবাইকে।’